নতুন বছরে কি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সংস্কার হবে
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ করলেই অগ্রগতির আর অবনতির খতিয়ান পাওয়া যায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এই ২০২৪ সালের শেষপাদে এসে কি পেল, আর নতুন বছরে কি-ই বা পেতে যাচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করছে এদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের এগিয়ে যাওয়া। এ বছরের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে দেড় দশকের পুরোনো ও স্বৈরাচারী শাসনের বিদায় হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল সংস্কার হবে সর্বত্র। চলচ্চিত্র অঙ্গনের সংশ্লিষ্ট সবারই আশা ছিল, এবার পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে চলচ্চিত্রের পালে। হাওয়া লেগেছিল ঠিকই, তবে সেই হাওয়া কি আমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে?
এমনিতে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের ছবি একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, বিশেষ করে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র ও কিছু মিডল সিনেমা; কিন্তু ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন বা এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র আসলে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এক শাকিব খানের হিট ছবি ছাড়া আর কিছু প্রসব করতে পারেনি। তাও প্রতি বছরও সেটা হচ্ছিল না। কাজেই এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র যেমন ম্লান হয়ে গেছে এরই ভেতর, সেরকম সিঙ্গেল স্ক্রিনও আস্তে আস্তে হয়ে পড়ছে জৌলুসহীন। বিদেশি, বিশেষ করে হলিউডের ছবি আমদানির পাশাপাশি স্বাধীন নির্মাতাদের চলচ্চিত্রের প্রতি দর্শকদের আগ্রহ মাল্টি স্ক্রিনের ব্যবসাকে চাঙা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে আরেকটি ব্যাপার গোপনে ঘটে গেছে।
ব্যাপারটি হলো এফডিসিকেন্দ্রিক ছবির শিল্পীরা কাজ করতে শুরু করেছেন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ছবিতে। বাংলাদেশে আপনি এফডিসি থেকে সহায়তা নিয়ে ছবি না বানালেও সেখানকার অনাপত্তিপত্র জোগাড় এবং সেজন্য পয়সা খরচ করতে হয়। বর্তমান সময়ে যারা প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র নির্মাতা, তাদের অনেকেই এফডিসির সহায়তা ছাড়াই চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন এবং অনাপত্তি পত্রের জন্য এফডিসির দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তখন কম তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হননি তারা। যেমন প্রায়ই বলা হতো এরা বড় পর্দায় নাটক বানায়, এরা সিনেমা বানাতে পারে না ইত্যাদি; কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের পর দেখা যাচ্ছে সেই তথাকথিত এফডিসিকেন্দ্রিক বাণিজ্যিক ছবির বড় বড় অভিনেতারাই এখন সেদিনের স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ছবিতে কাজ করছেন। শাকিব খান, ডিপজল, রুবেল, জায়েদ খান প্রমুখদের দেখা যাচ্ছে এফডিসির বাইরে নির্মিত ছবিগুলোতে কাজ করতে।
ইন্ডাস্ট্রির ভেতরে, বোঝা যাচ্ছে, বিগত এক যুগে একটি বড় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ছবি বিদেশের বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবেও আদৃত হচ্ছে। এমন একটি অবস্থার ভেতর ২০২৪ সালের আগস্টে ঘটে যায় পটপরিবর্তন। এই পরিবর্তনের পর যেহেতু সবাই সংস্কারের দাবি তুলল, চলচ্চিত্রের মানুষও চাইলেন কিছু পরিবর্তন আসুক। তারা ফিল্ম কমিশন চাইলেন, চলচ্চিত্র কেন্দ্র চাইলেন, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কমিটিতে নতুন লোক চাইলেন। কমিটিতে নতুন লোক এলো বটে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল কি পাওয়া গেল?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকেই দাবি-দাওয়া নিয়ে যারা সোচ্চার ছিলেন, তাদের উৎসাহে ভাটা পড়তে শুরু করে। প্রথম দুই মাসে যত বৈঠক ও সমাবেশ হয়েছে, তা যেন ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। সকলেই যেন বুঝে যায় সংস্কার চাইলেও সেটা রাতারাতি সম্ভব নয়। তাছাড়া চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া যেটা ছিল, সেন্সর সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে চলচ্চিত্র মুক্তি দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করা, সেটা আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে অনেকেই এখন সন্দিহান। কারণ বিগত সরকারের আমলে অন্য আদর্শের কোনো ছবি যেমন মুক্তি পায়নি, তেমনি এই সরকারের আমলে বিগত সরকারের আদর্শের ছবিও মুক্তি পাবে না। কাজেই চলচ্চিত্রের আসলে মুক্তি ঘটেনি। বাংলাদেশে আমরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে আদর্শের কাঁচিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই, শিল্প বা চলচ্চিত্রকে নয়।
যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের রাজনৈতিক আদর্শের দ্বারা পরিচালিত হয় আমাদের আমলাতন্ত্র। তাছাড়া, তারা শিল্পসাহিত্যের ব্যাপারে অতটা আগ্রহী নয়। কাজেই চলচ্চিত্র সবসময়েই রয়ে যায় গুরুত্বের সবচেয়ে তলানিতে। চলচ্চিত্র যেহেতু ব্যয়বহুল মাধ্যম, এর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বড় আকারে, তাই যতক্ষণ না পর্যন্ত নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে চলচ্চিত্রকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আসলে প্রকৃত সংস্কার হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তাছাড়া সমাজে যদি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান ঘটে, তাহলে তা চলচ্চিত্রের জন্য অশনী সংকেত। শুধু রাজধানী দিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করলে চলবে না, ঢাকার বাইরে চলচ্চিত্রের অবস্থা কেমন সেটাও দেখতে হবে।
আমাদের দেশের সব পরিচালক সব ধরনের ছবি কি দেশের সব প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিতে পারেন? এই প্রশ্নের বাইরে আরও প্রশ্ন রয়েছে। তারা দেশের যে কোনো স্থানে চাইলেই কি স্বাধীনভাবে, সবার সহযোগিতা নিয়ে শুটিং করতে পারছেন? যারা বিগত সরকারের আমলে শিল্পী হিসেবে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে অংশ নিয়েছেন, তারা কি বিনোদন জগতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন না? যারা বিগত সরকারের আমলে বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে কি এই আচরণ ঠিক ছিল? এমন নানাবিধ প্রশ্নের ভেতর দিয়েই আসলে আমাদের সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে। এফডিসি বলি, আর তার বাইরে, সবক্ষেত্রেই দখলদারিত্বের মানসিকতা হটিয়ে দিয়ে শিল্পচর্চায় মনোযোগী হতে হবে। একজন শিল্পীর রাজনৈতিক আদর্শ থাকতেই পারে, সেটা যেন তারা জীবন ও জীবিকায় বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। এর নামই সংস্কার।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে যে চলচ্চিত্র কেন্দ্র নির্মাণের দাবি তোলা হচ্ছে, সেটার জন্য পদক্ষেপ নেয়া মানেই সংস্কারের পথে পা বাড়ানো। আমাদের যে চলচ্চিত্র বিদ্যালয়গুলো রয়েছে, সেগুলোতে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও যুগোপযোগী সিলেবাস ঠিক করার মধ্য দিয়ে সংস্কার সাধিত হবে। অভ্যুত্থানের পর চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট যেসব কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেখানে রাজনৈতিক আদর্শকে গুরুত্ব না দিয়ে যোগ্যতার মাপকাঠিতে সদস্য নিয়োগ করা হলেই সংস্কারের উদ্যোগটি সফল হবে।
সংস্কার সবাই চায়। আমাদের চলচ্চিত্র বর্তমানে একটু একটু করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর কাড়তে শুরু করেছে। এখনই সময় একটি কার্যকরী ফিল্ম কমিশন ঘটন করে একে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। এসব সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলীয় সরকারের জন্য ফেলে রাখার কোনো মানে হয় না।
বিধান রিবেরু: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে