শীতের হাত ধরে রাজনীতিতে বাড়ছে উত্তাপ
প্রকৃতিতে শীত একটু একটু করে জেঁকে বসছে। এ মাসে বেশ কয়েকটি শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের জন্য শীত উপভোগ্য হলেও গরিব শ্রমজীবী মানুষের জন্য তা মোটেও আরামের নয়। প্রয়োজনীয় গরম কাপড়ের অভাবে শীত তাদের জবুথবু বানিয়ে দেয়। অসুস্থ ও প্রবীণদের জন্যও শীত একটা আতঙ্ক। তারা একটু উষ্ণতা চায়, চায় গরম পোশাক। কিন্তু তাদের সেই নিশ্চয়তা দেয়ার কেউ নেই।
এদিকে শীতের হাত ধরে রাজনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে উত্তাপ। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র তরুণরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের তৎপরতা চালাচ্ছে। এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বছরের শেষ দিনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করার ঘোষণা দেয়। কয়েক লাখ ছাত্র-জনতার জমায়েত ঘটিয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে মুজিববাদী সংবিধান হিসেবে তুলে ধরে তার ‘কবর’ রচনা করার ঘোষণা দেন নেতারা। একই সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করার কথাও ছিল। এরপর থেকেই এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার পাশাপাশি দেশজুড়ে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে এ নিয়ে তীব্র আপত্তি জানানো হয়। গণঅভ্যুত্থানের সমর্থক কয়েকটি বাম দলের পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ আসে। বিভিন্ন চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকেও আপত্তি আসে। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ইসলামী দল ছাড়া সব মহল থেকে এই মুহূর্তে সংবিধান বাতিলসহ ছাত্রনেতাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থান লক্ষ করা যায়।
সরকারের ওপরও চাপ বাড়তে থাকে। কারণ অনেকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনপুষ্ট বলে মনে করে। সমালোচনার মুখে প্রথমে ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই’ বলা হলেও আকস্মিক ৩০ ডিসেম্বর রাত ৯টায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেসসচিব শফিকুল আলম জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে জানান, সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে এবং গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করা হবে।
এই ঘোষণার পর হঠাৎ প্রেক্ষাপট বদলে যায়। সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিটি নিজেরা করবে বলে ঘোষণা দিল কেন—এই প্রশ্ন ওঠে। আসলে গণঅভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা অনেকটাই হাওয়ায় উড়ছিলেন। কিন্তু ৩১ ডিসেম্বর জুলাই প্রোক্লেমেশন ঘোষণার সিদ্ধান্তে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে সেটা তাদের কাছে ছিল অভাবনীয়। সরকারের জন্যও তা ছিল অস্বস্তির। বিএনপির আপত্তিতে কিছুটা বিচলিত হয়ে এবং বৈষম্যবিরোধীদের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে সরকার নিজেই জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরির দায়িত্ব নিয়েছে। অনেকের মতে, বৈষম্যবিরোধী নেতাদের ‘সেফ এক্সিট’ দিতেই সরকারের পক্ষ থেকে ওই ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
তবে সরকারের ঘোষণায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। দফায় দফায় বৈঠক করে গভীর রাতে ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভুলেশন’-এর বদলে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ নাম দিয়ে পরের দিনের কর্মসূচি বহাল রাখা হয়। যদিও এই কর্মসূচিতে যতটা লোক সমাবেশ আশা করা হয়েছিল, তা হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যা করছে, যেভাবে করছে, সেটা নিয়ে ক্রমেই প্রশ্ন উঠছে। বিশেষত তারা যেভাবে গণঅভ্যুত্থানের মালিকানা দাবি করছেন, যেভাবে নীতিনির্ধারকদের মতো কথা বলছেন, তা বিএনপি মেনে নিতে পারছে না। বিএনপি নেতারা তো ইদানীং প্রকাশ্যেই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। দেশে একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে, সেটা আওয়ামী লীগকে সরিয়ে দেয়ার পর বিএনপিকেও সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ। সংবিধান বাতিলের দাবির সঙ্গেও বিএনপি একমত নয়। সংবিধান বাতিলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির সমালোচনা করছেন বিএনপির নেতারা। তাদের মতে, এই সংবিধানের আলোকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনসহ সবকিছু চলছে। তাই সংবিধান বাতিলের কথা যারা বলছেন তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ্য করে বেশ কড়া বক্তব্য দিয়েছেন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগর ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘আন্দোলন নিয়ে নতুন নতুন বয়ান শোনা যাচ্ছে। একটি মহল আন্দোলনের মালিকানা হাইজ্যাক করে নিয়ে যেতে চাইছে। আন্দোলনের মালিকানা হাইজ্যাকের চেষ্টা করবেন না। বয়ান দেয়ার আগে একটু চিন্তা করে দেখবেন। আমরা এ আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই না। এ আন্দোলন বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের আন্দোলন।’ আমীর খসরু আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা নির্বাচিত সংসদ, সরকারের হাতে তুলে দেয়া। এর বাইরে আর কোনো দায়িত্ব নেই। আর যে সংস্কারের গল্প করা হচ্ছে সেগুলো হবে আগামী সংসদে। অর্থাৎ নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা যত সংস্কার প্রয়োজন তা করবে।’
বিএনপি ক্রমেই নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও তাদের বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। জামায়াতকে কটাক্ষ করেও বিএনপি নেতারা বক্তব্য রাখছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেভাবে আওয়ামী লীগ একা একদিকে আর সব রাজনৈতিক শক্তি তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, বিএনপিও আপাতত তেমন অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। চিন্তা-চেতনার দিক থেকে জামায়াত, সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং কিছু কিছু ইসলামী দল বর্তমানে মোটামুটিভাবে কাছাকাছি অবস্থানে আছে। তাদের সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিএনপি। আগামীতে এই দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আগামীতে বিএনপির সঙ্গে সরাসরি বিরোধে জড়াবে, না কোনো আপসরফার পথ অনুসরণ করবে তার ওপর দেশের ভবিষ্যতের রাজনীতি অনেকটাই নির্ভর করছে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও ছেড়ে কথা বলবে বলে মনে হচ্ছে না। ৩১ ডিসেম্বর মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচি তারই নমুনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি যে রাজনৈতিক শক্তি আকারে হাজির হতে যাচ্ছে, তারই একটি ‘শোডাউন’ ছিল এ কর্মসূচি। এরই মধ্যে দেশের অনেক জেলা-উপজেলায় দুটি প্ল্যাটফর্মেরই কমিটি হয়েছে। জেলা-উপজেলা থেকে বাস ভাড়া করে সেসব কমিটির মানুষ এসেছেন সেদিনের কর্মসূচিতে।
শীতের শুরুতে রাজনীতিতে যে আঁচ সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগিয়ে চলুক দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা তেমনই। কোনো উগ্র কর্মসূচি ও বিরোধ বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, রুটি সেঁকার জন্য তাওয়া গরম করতে হয়। আবার সেই তাওয়া বেশি তেতে গেলে রুটি যায় পুড়ে। তখন খাবারের থালার বদলে রুটির জায়গা হয় ডাস্টবিনে। রাজনীতিতেও তেমনটাই ঘটে। মানুষজনকে চাঙা করার জন্য অনেক সময় নেতারা গরম গরম ভাষণ দেন। কিন্তু তা মাত্রা ছাড়ালে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। পাতে তোলে না। বলতে বাধা নেই, কথায় ও কাজে মিল না থাকার কারণে অনেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বর্তমান সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হচ্ছে। আবার সারা দেশে অলিখিত দখল-চাঁদাবাজি এবং নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ার কারণে বিএনপির প্রতিও অনেকের ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে।
এই ক্ষোভ নিরসনে উভয় পক্ষকে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংঘাতের পথ এড়িয়ে ঐক্যের পথে হাঁটতে হবে। কাজটি সহজ নয়। সব পক্ষকে মনে রাখতে হবে যে, সাফল্যের কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। সাফল্য আসে ধারাবাহিকতার হাত ধরে। ধারাবাহিক ও সংযত আচরণেই পূরণ হয় উদ্দেশ্য। অবিরাম বৃষ্টিধারা মাটির একটার পর একটা স্তর ভেদ করে ধীরে ধীরে পৌঁছায় গভীরে। পুষ্ট করে ভূগর্ভস্থ জলাধার। সেই বিশুদ্ধ জলই মানুষের জীবন বাঁচায়। ধীরস্থির, ধারাবাহিক ও দূরদর্শী উদ্যোগ মানুষের মনের গভীরে জায়গা করে নেয়। সুরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ভরসা জোগায়। এর ব্যত্যয় হলে অতীতের পুনরাবৃত্তি ছাড়া তেমন কিছুই ঘটবে না।
লেখক: কলামিস্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে