Views Bangladesh Logo

মানবিকের ছাত্রী জাল সনদে হয়ে গেলেন বিমানের পাইলট

পড়ালেখা করেছেন মানবিক বিভাগে । অথচ  ঢাকা বোর্ডের একটি জাল সনদ ব্যবহার করে নিজেকে বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ দেখিয়ে  উড়োজাহাজ চালানোর  প্রশিক্ষণ নেন।  সেই জাল সনদেই রিজেন্ট এয়ারওয়েজে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে ২০১৩ সালে যোগ দেন সাদিয়া আহমেদ। অদক্ষতা ও বিপজ্জনকভাবে উড়োজাহাজ চালনা করায় ২০১৬ সালে চাকরিচ্যুত হন। ২০১৭ সালে একই লাইসেন্স ব্যবহার করে ইউএস বাংলায় যোগ দেন। তবে অদক্ষতার জন্য সেখানেও বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেননি।

সর্বশেষ  সাদিয়া আহমেদ ২০১৯ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৩৭-এর ফার্স্ট অফিসার হিসেবে যোগ দেন। অভিযোগ ওঠে, তার স্বামী বিমানের ঐ সময়ের প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদের হস্তক্ষেপেই এখানে নিয়োগ পান। তবে, লাইসেন্সিং পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ, অযোগ্যতা ও উড্ডয়ন ঘাটতি থাকায় প্রশ্নবিদ্ধ হয় এ নিয়োগ প্রক্রিয়া। পরে ২০২৩ সালের ৩০ মার্চ তাকে অব্যাহতি দেয় বিমান বাংলাদেশ। এ সময় ঢাকা বোর্ডের জাল সনদ জালের বিষয়টি প্রকাশ হলে  একই বছর ২২ নভেম্বর লাইসেন্স বাতিল করে সাদিয়ার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। 

সনদ জালিয়াতি করে অদক্ষ কারও পাইলট হওয়ার গল্প এভাবেই শেষ হতে পারত, কিন্তু বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও বিমানের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সিভিল এভিয়েশনে রিভিউ আবেদন করেন সাদিয়া। সেই আবেদনের ভিত্তিতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। আর সেই তদন্তেই উঠে আসে সনদ জালিয়াতির আরও আশ্চর্যজনক তথ্য। এবার কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে আরও একটি জাল সনদ নিয়ে এসে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করেন সাদিয়া। শেষ পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের জাল সনদের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

 সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার পর এ বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামে ভিউজ বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০০৮ সালে এইচএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষায় পাস করার যে সনদ সাদিয়া জমা দেন, সেই সূত্র ধরে ভিউজ বাংলাদেশ নবাবগঞ্জের দোহারে জয়পাড়া সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অনুসন্ধান চালায়।

ভিউজ বাংলাদেশের অনুসন্ধানে দেখা যায়, জয়পাড়া সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে সাদিয়া আহমেদ নামে ২০০৬-০৭ সেশনে কোনো ছাত্রীই ছিল না।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইট তথ্য সূত্রে জানা যায়, সাদিয়া আহমেদ ২০০৮ সালের এইচএসসি শিক্ষার্থী যার রোল নং ৮০২২৬৫ এবং রেজি নং ৬৯৬৯২৫, সেশন : ২০০৬-০৭। তার ট্রেড/স্পেশালাইজেশন অ্যাগ্রো মেশিনারি। তার পিতার নাম: সালাহ্ উদ্দিন আহমেদ, মাতার নাম: তালাত জামানি মজুমদার।

ভিউজ বাংলাদেশের কাছে বিষয়টি জানতে পেরে জয়পাড়া সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে কর্তৃপক্ষ চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন।

তদন্ত কমিটির থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে, কলেজটির অধ্যক্ষ নুর উদ্দিন আহমদ একটি লিখিত প্রতিবেদন জারি করেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাদিয়া আহমেদ নামে কোনো শিক্ষার্থী ২০০৮ সালে এইচএসসিতে এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত অবস্থায় ছিল না। ভর্তি ও ফলাফল রেজিস্টার যাচাইবাছাই করে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, উল্লিখিত রোল ও রেজিস্ট্রেশনধারী শিক্ষার্থীর নাম সাদিয়া আহমেদ নয় বরং তার নাম মো. নাসির উদ্দিন।

অধিকতর তদন্তে জানা যায়, মো. নাসির উদ্দিন জয়পাড়া সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০০৪ সেশনে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। এরপর ২০০৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ ৩ দশমিক ৮২ পেয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডেন অধীনে উত্তীর্ণ হন। সেই সময় তার রেজি. নম্বর ছিল ০০৪৫৩৮ এবং রোল নম্বর ছিল ৩০৩৭৭৫। তারা পিতা: মো. নূরুল ইসলাম, মাতা: লাইলি বেগম।

পরবর্তীতে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০০৬-০৭ সেশনে ভর্তি হয়ে ২০০৮ সালে ট্রেড/স্পেশালাইজেশন অ্যাগ্রো মেশিনারি বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। যেখানে তার রোল নম্বর ছিল ৮০২২৬৫ এবং রেজি. নং ৬৯৬৯২৫। ২০০৮ সালে এইচএসসি বোর্ড সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। তিনি রসায়ন বিষয়ে অকৃতকার্য হন।

অথচ, একই রোল এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর সম্বলিত সনদে দেখা যায়, সাদিয়া আহমেদ ৪ দশমিক ৯০ পেয়ে এ প্লাস নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন।  এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারাও বিস্ময় প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সচিব মো. আল মাসুদ করিম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সার্টিফিকেটের তথ্য জালিয়াতির বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে আমরা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের স্বচ্ছতা ফেরাতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ইতোমধ্যে বুয়েটের একটি ফরেনসিক টিমকে তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ দেয়া হয়েছে। আমাদের হাতে ফরেনসিক রির্পোট এলে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হবে।’

কীভাবে সার্টিফিকেট জালিয়াতি হয়েছে- এমন তথ্যের জবাবে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কেপায়েত উল্লাহ বলেন, ‘বোর্ডের তথ্য সিডি ড্রাইভের মাধ্যমে টেলিটককে দেয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে ওখানে আগের তথ্য পরিবর্তন বা জালিয়াতি হয়েছে। সাবেক সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ ধরনের অপরাধের দায়ে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে তার হাতে কম্পিউটারের সার্ভারে আপলোড এবং সিডি পাঠানোর দায়িত্ব ছিল। বর্তমানে একই ব্যক্তির হাতে দুটি দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না এবং একই সঙ্গে এ বিষয়গুলো বিশেষভাবে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।’

একাধিক কর্মকর্তা জানান, বোর্ডের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী গত এক যুগে অর্থের বিনিময়ে লক্ষাধিক জাল সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, টেকনোলজি, ফিশারিজসহ বিভিন্ন বিষয়ে ডিপ্লোমা সনদ বিক্রি করা হয়েছে। এসব সনদ ব্যবহার করে অনেকে চাকরি করছেন বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। প্রায় ৩০ হাজার ভুয়া কম্পিউটার শিক্ষা সনদ দিয়ে কয়েক হাজার শিক্ষকও এমপিওভুক্ত হয়েছেন। সনদগুলো বোর্ডের সার্ভারে তথ্য আপলোড করে বৈধতার ছাপ দেয়া হতো, ফলে নকল সনদ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ত।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ