Views Bangladesh Logo

পর্ব ১

আত্মশুদ্ধি ছাড়া দেশের বিশৃঙ্খলা থামবে না

Farida Parveen

ফরিদা পারভীনএর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার

‘এই পদ্মা, এই মেঘনা’, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’ বহুল জনপ্রিয় গানগুলো শুনলে যার অবয়বটি ভেসে ওঠে, তিনি লালনকন্যাখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন। লালন ফকিরের গান সবচেয়ে বেশি গেয়েছেন তিনি। ৫৪ বছর ধরে লালন, নজরুল, দেশাত্মবোধকসহ ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত গাইছেন তিনি। সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘একুশে পদক’। পেয়েছেন জাপানের ‘ফুকওয়াকা’ পুরস্কার, যেটি এশিয়ার নোবেল হিসেবে পরিচিত। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। এ ছাড়াও পেয়েছেন দেশি-বিদেশি অসংখ্যা পুরস্কার ও সম্মাননা।

সম্প্রতি ভিউজ বাংলাদেশ অফিসে এসেছিলেন তিনি। গান-আড্ডায় মুখর করে রেখেছিলেন ভিউজ বাংলাদেশ অফিস। এর মাঝেই তিনি কথা বলেছেন তার সংগীতজীবনের পথচলা, লালনসংগীত, বাংলা সংগীতাঙ্গনের নানান বিষয় নিয়ে। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের সহযোগী সম্পাদক গিরীশ গৈরিক ও সম্পাদকীয় সহকারী শাহাদাত হোসেন তৌহিদ

ভিউজ বাংলাদেশ: সত্তরোর্ধ্ব জীবন আপনার। পুরো জীবনটাই সংগীতের সঙ্গে, জীবন নিয়ে সংগীত নিয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাই?

ফরিদা পারভীন: এই বয়সে প্রথম অনুভূতি হচ্ছে আরেকটু বাঁচতে ইচ্ছে করে। আরও কিছু সংগীতের জন্য ভালো করার ইচ্ছা জাগে। তারপরও মানুষ তো মরণশীল। দুনিয়ার জীবন অস্থায়ী। সেখানে তবুও আল্লার অশেষ মেহেরবানি যে, এত অসুস্থতার পরও আমি এখনো গান করতে পারি। জীবন থাকলে তো অসুস্থ হবে আবার ভালো হবে। ভালো-মন্দ মিশিয়ে আছি। সংগীতচর্চাই করছি। একাডেমিক কাজ করছি। ফাউন্ডেশনের আদলে সবকিছু করার চেষ্টা করছি। বাচ্চাদের একডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যদি বলেন তাহলে প্রথম তো স্বপ্ন ছিল অচিনপাখি। আমি যেহেতু লালন সাঁইজির গানেই নিজেকে অবগাহন করেছি, সেখানে আমি চেয়েছি আমার মধ্যে আমার গুরু এবং লালন ফকির বেঁচে থাকবে। আমার বাচ্চাদের গুরু-শিষ্যের যে পরম্পরায় আছি, সাঁইজির তরিকায় সেটি ওদের বোঝানোর জন্য চেষ্টা করেছি পরিপূর্ণরূপে মানুষরূপে। শুধু মানুষরূপের চেহারা নয়, মনুষ্যত্ব নিয়ে যেন তারা জীবনে সমৃদ্ধ লাভ করে এবং এগিয়ে যেতে পারে।

ভিউজ বাংলাদেশ: ভাষা আন্দোলনের পরপরই আপনার জন্ম, স্বাধীনতাযুদ্ধ দেখলেন, ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থান, সর্বশেষ ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানও দেখলেন শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। মানুষের ওপর শোষণমুক্তি কতদূর?

ফরিদা পারভীন: নিজেকে সুধরাতে হবে। আমরা যদি আত্মশুদ্ধি লাভ না করতে পারি, হবে না। সাঁইজি বলছেন, ‘সত্য বল সুপথে চল, ওরে আমার মন। সত্য সুপথ না চিনিলে, পাবিনে মানুষের দর্শন।’ আমাদের মধ্যে মিথ্যা জড়িয়ে আছে। মিথ্যাকে সত্যের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছি। কিন্তু সত্যকে সত্যভাবে নিজেকে আত্মশুদ্ধি লাভ করতে হবে। এটা লালন সাঁইজির কথা। লালন সাঁইজি বহু গানের মধ্যে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। মানব কল্যাণের কথা বলবার চেষ্টা করেছেন। সে জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, আত্মশুদ্ধি লাভ করতে হবে। তারপর আপনার দেশ বলেন, জাতি বলেন, পরিবার বলেন- সত্য পথে এগিয়ে যাবে। সত্য পথে যারা এগোয় তাদের এত সাহস থাকবে, তাদের কোনো ভয় নেই। কাজেই আত্মশুদ্ধি ছাড়া দেশের বিশৃঙ্খলা থামবে না আল্লাহ বলেন, ভগবান বলেন, ঈশ্বর বলেন- তার ওপর তায়াক্কুল করতে হবে। আমি মুসলমান হিসেবে বললাম।

ভিউজ বাংলাদেশ: বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি দেশের বাউল শিল্পীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে। ৫ আগস্টের পর সেই নির্যাতন আরও বেড়েছে। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

ফরিদা পারভীন: আমি মনে করি মানুষের প্রতি কেন আমি অবিচার করব? যার যার কর্ম সে করবে। আমি-আপনি কে বলার? তবে হ্যাঁ আজকাল আবার এটাও ঠিক, গানের মধ্যে অস্থিরতা এগুলো লালন ফকিরের গানে গাহ্য করে না। লালন ফকিরের বাণী হচ্ছে ভাবজগতের গান। গায় ভালো ঠিক আছে কিন্তু এই যে নাচানাচি করে এর মাঝে অনেক অহেতুক কাজ হয়। যে কারণে এটার জন্য যারা দেখতে পায় তারা হয়তো এটাকে উচ্ছৃঙ্খল মনে করে তাকে হয়তো প্রতিহত করে। তারপরও আমি বলি, প্রতিহতের দরকার নাই তো, তাদের বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। আলাপ-আলোচনার সঙ্গে কতটুকু কাজ করবে সেইভাবে করো। লালনের গান ষাট বছর আমি গেয়ে যাচ্ছি, কই আমার গানে, আমার কথায়, আমার চালচলনে কেউ কখনো উচ্ছৃঙ্খলতা পেয়েছে? না, পায়নি। আমি দ্ব্যর্থহীন এবং দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলেছি।

দ্বিতীয়ত, কিছু কিছু সুর আছে অশ্রাব্য। সুরের একটা আবেদন আছে। সুর নিঃসন্দেহে ঐশ্বরিক। সেটা আপনি মুসলমান-হিন্দু যে ধর্মেরই হোন না কেন- সুর হচ্ছে ঐশ্বরিক। আমি যদি মুসলমান হিসেবে কথা বলি, সুর এমন একটা জিনিস যে হজরত বেলালের কণ্ঠে আজান না হলে সকাল হতো না। সকাল চিন্তা করতো-প্রত্যাশা করতো কখন হজরত বেলাল আজান দিবেন, আমি ভোর হব। এই যে একটা বিষয় এটা কতো গভীর। কেউ এটা মানুক না মানুক- এটা তো হাদিসের কথা। তারপরও এরা যা খুশি তাই করছে ভাই, এটা ঠিক না। কিন্তু যারা আদি লালন সাঁইজির ভক্ত, লালন সাঁইজিকে ধ্যান করে তারা এসব করে না। তারা স্থির হয়ে লালনের গান পরিবেশন করেন। এটাই হচ্ছে, এটাই প্রথম থেকে আমি দেখে এসেছি। আমি যেদিন প্রথম ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানটি করলাম কেন জানি মানুষের কাছে এত ভালোবাসা পেল, তখন মানুষ বললো- আরেকটা হোক, আরেকটা হোক। কিন্তু সংগীতের সঙ্গে আমি প্রতারণা করিনি। করিনি বিধায় আমি ওখানে সত্য কথা বলেছিলাম যে ভাই, আমি এখনো শিখিনি। আমি শিখে আসি তারপর আপনাদের শোনাব। সত্য কথা বলে ফেলেছি। ঘটনাগুলো যে কতো গভীর কতো ঐশ্বরিক অনুরণন, সেটা কিন্তু আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এটা উপলব্ধির ব্যাপার।

এ জন্য বলছি, শালীনভাবে, সুন্দরভাবে লালনের বাণীকে প্রচার করার যে প্রয়াস এটা যেই হোক না কেন, যত বড় ফকির হোক না কেন- ফরিদা পারভীন সেটা পছন্দ করছে না। ফরিদা পারভীন আদি গুরু ধরে এখানে এসেছে। এখানে হেনতেন করে সিডি শুনে ইউটিউব দেখে এসব ফরিদা পারভীন করে না। আজকে ষাট বছর এটাকে চর্চা করে আয়ত্ত করে আত্মনিবেদন পরে এ পর্যন্ত আমি নেয়ার চেষ্টা করেছি। হয়েছে কি না আমি জানি না। সেটা আমার জনগণ বলবে।

সারা পৃথিবীতে আমাকে এখন সুফি আর্টিস্ট বলে। মরক্কো, তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, বেলজিয়াম এসব জায়গায় আল্লাহ আমাকে নিয়ে গেছেন এবং সুফি আর্টিস্ট হিসেবে তারা আমাকে গণ্য করেছেন। ফ্রান্সে তো আমি রেকর্ড করে আসছি। ফ্রান্সের গানের সঙ্গে যৌথভাবে একটা প্রজেক্টে কাজ করেছি।
(চলবে)

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ