Views Bangladesh Logo

আন্তর্জাতিক নারী দিবস

৫ আগস্টের পর থেকে রাজনৈতিকভাবে নারীদের দূরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে

Umama  Fatema

উমামা ফাতেমা

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন অভ্যুত্থানের আগে ছিল কোটাবিরোধী আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমরা সব নারী শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে আসতাম। প্রথম দিকে আসলেও, ছেলেদের হলে যেহেতু ছাত্রলীগের প্রেসার থাকত, পরে আস্তে আস্তে তাদের সংখ্যা কমে যায়। মেয়েদের হলে যেহেতু প্রেসারটা সেভাবে ছিল না, দেখা যেত মেয়েরা বড় মিছিল নিয়ে আসতে পারত। এখানে বদরুন্নেছা কলেজ, পাশে ইডেন কলেজ আছে, ঢাকা নার্সিং কলেজ আছে,  জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সব জায়গা থেকেই মেয়েরা বিরাট মিছিল নিয়ে আসত। এই যে মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত বড় একটা অংশগ্রহণ, এটা আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। আমরা ভেবেছিলাম মেয়েদের বিশাল অংশগ্রহণ থাকলে ছাত্রলীগ মারার সাহস পাবে না।

১৪ জুলাই যখন আমরা মেয়েরা হল থেকে বেরিয়ে আসি, ১৫ জুলাই আমাদের ওপর হামলা হয়; মেয়েদের ওপর এই হামলা সমাজ ভালো চোখে দেখেনি; সাধারণ মানুষ তখনই বেশি করে ফুঁসে ওঠে। এত ব্যাপকভাবে আমাদের ওপর হামলা হয়েছিল, এবং এত বেশি ছাত্রী আহত হয়েছিল, সাধারণ যে কোনো মানুষের কাছেই এটা ছিল হৃদয়বিদারক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রীদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশজুড়ে। পরবর্তীতে আবু সাঈদ শহীদ হলে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।

তবে, আমি যেটা বলব, আমরা তো বড় হয়েছি মূলত শেখ হাসিনার আমলে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আমাদের শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের বড় একটা অংশই আমরা শেখ হাসিনার আমলে কাটিয়ে দিয়েছি। ওই সময়টাতে আমরা কোনো প্রতিবাদ জানাতে পারিনি। এই দেশ নিয়ে আমাদের তরুণদের চিন্তা কী, তা কখনোই জানাতে পারিনি। আমরা যারা তরুণ, তাদের মধ্যে যারা নারী, ২০০০ সালের পর কিন্তু জব সেক্টরে তাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে; কিন্তু পলিটিক্যালি নিজের ভয়েস রেইজ করার সুযোগ এখানে কম ছিল। যার কারণে নারীরা কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। শিক্ষাক্ষেত্রে, পেশাগত জীবনে যে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে- এর দিকে কিন্তু সেভাবে নজর পড়েনি।

বিসিএস চাকরিটা যেহেতু একটা সেফ চাকরি সেহেতু মেয়েদের মধ্যেও কিন্তু এর প্রতি একটা আকর্ষণ তৈরি হয়। যেহেতু নারীরাও চাকরি করতে চায়। আবার পারিবারিক জীবনও তাকে কাটাতে হবে। তাই যে কোনো মেয়েরই পছন্দ থাকে বিসিএস বা সরকারি ব্যাংকে চাকরির প্রতি। সে জায়গা থেকেও এই আন্দোলনে মেয়েদের একটা প্রাধান্য ছিল। সেই জায়গা থেকে মেয়েরা যখন এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এল, এ ক্ষেত্রে মেয়েদের একটা বড় আশা ছিল কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানো।

খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এর পর ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানটি হয়েছে। মেয়েদের পুলিশ টার্গেট করে গুলি করত না; কিন্তু মেয়েরা রাস্তায় ছিল। পুলিশের সঙ্গে মারামারিও করেছে। তাও আমাদের অনেক সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। প্রায় ৯ জন নারীযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। আরও প্রচুরসংখ্যক নারী আহত হয়েছেন। গণঅভ্যুত্থানের সময় আমাদের কখনো মনে হয়নি আমরা নারী বা পুরুষ হিসেবে এই আন্দোলনে আছি। মনে হতো আমিও একজন মানুষ, এই দেশের একজন নাগরিক, আমারই সহ-নাগরিক; সে নারী হোক, পুরুষ হোক- এখানে মৃত্যুবরণ করছেন, তার ওপর হামলা হচ্ছে, নাগরিক বোধের জায়গা থেকেই আমরা সবাই রাস্তায় নেমে এসেছিলাম। কারণ শেখ হাসিনা তো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নির্যাতন করেনি, বা ধর্ম-নির্বিশেষে নির্যাতন আলাদা আলাদা করেনি, সবাকেই একইরকম নির্যাতন করেছে। এটাই সবার মধ্যে নিপীড়নের অনুভূতি তৈরি করে।

কিন্তু ৫ আগস্টের পর যেটা হলো, তখনই আসল ক্ষমতার প্রশ্ন। প্রথম কিছুদিন সরকার ছিল না; এবং তখনই মেয়েদের মাইনাস করার প্রক্রিয়া শুরু হলো। আমি আমার জায়গা থেকে বলতে পারি, বাকিরা হয়তো তাদের জায়গা থেকে বলতে পারবে। আমি যেটা খেয়াল করি, আমার কাছে প্রথমে এটা মনেই হয় নাই যে আমাকে ক্ষমতায় যেতে হবে। আমার উপদেষ্টা হওয়া দরকার। আমাদের মধ্যে যারা উপদেষ্টা হলো, নাহিদ ভাই, আসিফ ভাই, আমরা খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম যে, আচ্ছা, ঠিক আছে, আমাদের মধ্য থেকেই কেউ উপদেষ্টা হচ্ছেন; কিন্তু সোসাইটির মধ্যে থেকে কেউ দাবি তুলেন নাই যে, নারীদের মধ্য থেকেও কাউকে উপদেষ্টা করার। সত্যি বলতে আমি নিজের মধ্যে এটা ফিল করি নাই যে নারীদের মধ্যে কাউকে উপদেষ্টা হতে হবে। কারণ আমরা সবাই তো সহযোদ্ধা, সবাই অভ্যুত্থানে ছিলাম। তো আমাদের মধ্য থেকে দুজন যাচ্ছে, এটা আলাদা করে দেখার কিছু না।

কিন্তু এটা যেহেতু ক্ষমতার খেলা, ধীরে ধীরে দেখা গেল সবাই ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছে। ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার ধাক্কাধাক্কিতে মেয়েরা পিছিয়ে যায়। ৫ আগস্টের পর একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে আমিও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি। আমাকে দাঁড়াতে দিবে না। দাঁড়াতে না দেয়ার যত ধরনের প্রসেস আছে, গায়ে হাত দেয়া, গুতাগুতি করা- এসব প্রসেসের মধ্য দিয়ে সাইডে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর আমি আসলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মের আর কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি নাই। আমার এত বাজে অভিজ্ঞতা ছিল সেটা। আরও কয়েকটা ঘটনা ছিল। আমি দেখলাম যে প্রত্যেকবারই আমি সেক্সুয়ালি টার্গেটেড হচ্ছি।

গণঅভ্যুত্থানে আগে আমাকে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়েছে; কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর দেখলাম আমাকে সাইডে সরানোর একটা পদ্ধতি হিসেবে যৌন হয়রানি করা হচ্ছে। আমার গায়ে হাত দেয়া হচ্ছে। আমাকে প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে আমি একটা মেয়ে। আমাকে যদি সামনে আসতে হয় তাহলে এই সেক্সুয়াল হেরেজমেন্টগুলো সহ্য করে করেই আসতে হবে। এ ধরনের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলো। যার কারণে আমাদের অধিকাংশ মেয়েরাই সরে গেল, ঘরে ঢুকে গেল। কিন্তু ৫ থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত যখন সরকার ছিল না তখনো কিন্তু মেয়েরা রাস্তায় ছিল। ট্রাফিক কন্ট্রোল করেছে। বাসার বাইরে পাহারা দিয়েছে। ছেলে-মেয়ে উভয়ই ছিল, কেউ আলাদা করে ছিল না। ছেলেরা মেয়েরা একসঙ্গে মোহাম্মদপুর, গুলশান এলাকায় রাস্তা পাহারা দিয়েছে। সবাই মিলে লাঠি হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। কেউ তো মনে করেনি, ও মেয়ে, ও কেন রাত ১০টায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে? ওটাকে সবই সুন্দরভাবেই দেখেছে।

কিন্তু ৮ আগস্টের পর দেখা গেল আস্তে আস্তে একটা নোংরা প্রসেস শুরু হয়েছে। দেখা গেল যার যার পছন্দের মেয়েকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে; কিন্তু যে মেয়েটার নেতৃত্বের গুণাবলী আছে, অতো ভাই ভাই করবে না, তাকে অপমান করে হোক, হাত দিয়ে ঠেলে দেয়া হোক, সরিয়ে দেয়া হবে। স্টেজে দাঁড়াতে দিবে না। ফলে অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে মেয়েদের একটা বড় অংশ সরে যায়। আমি যখন দেখলাম মেয়েরা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে তখন অক্টোরের ২০-২১ তারিখের দিকে আমি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্বপালন শুরু করি। কারণ মেয়েদের তো আসলে কোনো প্রতিনিধি নাই, এখন আমিও যদি এখানে না থাকি তাহলে মেয়েদের কথাটা বলবেটা কে?


এর আগ পর্যন্ত কিন্তু আমরা মেয়েদের নিয়ে আলাদা করে কথা বলছিলাম না। এর কারণ হলো দেশে এত বড় একটা গণহত্যা হয়েছে, তার বিচার না চেয়ে আমি যদি নারীদের জন্য আলাদা কোনো দাবি তুলি তাহলে আমাকে স্বার্থপর বানিয়ে দেয়া হবে। অনেকে বলবে, “দেখে দেখো, নিজের আখের গোছানোর জন্য ও ‘উইমেন কার্ড’ খেলতেছে।” এরকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। এ জন্য শুধু আমি না, বেশিরভাগ মেয়েকেই আমি দেখেছি নারী ইস্যুটাকে আলাদা করে সামনে নিয়ে আসে নাই। মেয়ে কমিউনিটি হিসেবে আমরাই কিন্তু এ ছাড়টা দিয়েছি। আমরা ওদের স্পেসটা ছেড়ে দিয়েছি। পরে মনে হয়েছে এটা আমাদের উচিত হয় নাই।

নারীদের এই নাই করে দেয়ার প্রবণতাটা একদিকে যেমন সাংস্কৃতিক, আরেকদিকে রাজনৈতিকও। মেয়ে হিসেবে আমরা সাধারণভাবেই একটু ভিড় এড়িয়ে চলি; কিন্তু এখানে রাজনৈতিক ক্ষমতাতন্ত্রের বিষয়ও আছে। হয়তো মনে করা হয়েছে একজন নারী যদি আহ্বায়ক হয়, বা উপদেষ্টা হয় বা সদস্য সচিব হয় তাহলে তো ও অনেক বেশি ক্ষমতাবান হয়ে যাবে; এটা রাজনৈতিকভাবেই প্রতিহত করা হয়েছে।


আরেকটা বিষয় হচ্ছে, নারীরা তো রাজনীতিতে আসতে চায় না, আন্দোলনের পর ওরা সবাই ঘরে ফিরে গেছে; এটা একটা উছিলা বানানো হয়েছে। যদি কোনো পলিটিক্যাল পার্টিকে জিজ্ঞেস করা হয়, অভ্যুত্থানের পরে নারীরা কেন ঘরে ফিরে গেল? তারা খুবই এবসার্ড একটা উত্তর দিবেন। তারা বলবেন, অভ্যুত্থানের সময় দরকার পড়েছিল তাই এসেছিল। মেয়েরা তো রাজনীতিতে থাকে না, তাই ফিরে গেছে; কিন্তু আসল ঘটনা হচ্ছে ৫ আগস্টের পর পলিটিক্যালি মেয়েদের সাইডলাইনে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

আমি মনে করি অবচেতনভাবে এটা পুরুষতন্ত্রের কারণেই হয়েছে। পুরুষতন্ত্রের কারণেই ছেলেরা অনেক বেশি সুযোগ পেয়েছে এবং সত্যি বলতে আমি জুলাই মাসের শুরু থেকেই এটা বুঝতে পারছিলাম। নারীদের তারা ডাকতো দরকার হলে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকেই নারীরা বৈষিম্যের শিকার। এখন দেশে যে ধরনের সংকট হচ্ছে, বিশেষ করে নারীদের ওপর যে ধরনের মব জাস্টিস হচ্ছে তার কারণ আমাদের সরকারের কোনো পজিশন নাই। সবার অংশীদারত্বের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, এখন যখন মেয়েদের নানাভাবে হেরেজমেন্ট করা হচ্ছে তখন সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। গণঅভ্যুত্থানের আগেও মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে অনেক ভয় পেত। এখন এই ভয়টা পায় না। এর কারণ মেয়েদের হেরেজমেন্ট করলে বা নির্যাতন করলে সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। মেয়েদের যে আলদা করে নিরাপত্তা দেয়া দরকার এটা সরকার মনে করছে না। তা ছাড়া সরকার এত এত সমস্যায় জর্জড়িত প্রতি মুহূর্তে, নারীদের সমস্যাটা সরকারের কাছ বড় সমস্যা মনে হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরকার যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলার প্রধান শিকার হচ্ছেন নারীরা।

নারীদের এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একটা সাংস্কৃতিক যুদ্ধ করতে হবে। দেশে তো এখন শিল্প-সাহিত্য একেবারে নাই হয়ে গেছে। নারী জাগরণের জন্য এই সাংস্কৃতিক লড়াইটা করতে হবে। জুলাইয়ের যে সাংস্কৃতিক রাজনীতি আমাদের এখানে অবমুক্ত হওয়ার কথা ছিল সেটা আরও অবদমিত হয়েছে। জুলাই কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় এগুলো আরও ভালো করে পর্যালোচনা করা দরকার। মেয়েদের আরও ভয়েজ রেইজ করতে হবে। মেয়েদের আরও বেশি ভোকাল হওয়া উচিত।

উমামা ফাতেমা: মুখপাত্র, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন  

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ