Views Bangladesh Logo

নারীর সমঅধিকার বনাম নারীর কর্তব্য জ্ঞান

Maria Salam

মারিয়া সালাম

নারীর সম-অধিকার স্থাপনের ব্যাপারে আমার সবচেয়ে বড় মতামত, অধিকার ভোগ করতে হলে কর্তব্য পালন করতে হয়। এটাই নিয়ম। সামাজিক ভাবে নারীর অবস্থান বা নারীর প্রতি পরিবারের মনোভাব সম এবং সম্মানজনক না হলে নারীর মধ্যে কর্তব্য পালনের স্পৃহা জেগে উঠবে না। পারিবারিকভাবে নারীকে সমান হিসেবে গণ্য না করলে নারীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে উঠবে না। নারীর জন্য প্রথমে সবচেয়ে জরুরি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার সক্ষমতা ও সাহস অর্জন করা। সেটি না থাকলে, সম্পত্তিতে সম-অধিকার কেবল তার জন্য পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। আমার দাদি পিতার সম্পত্তির ভালো একটা অংশ পেয়েছিলেন; কিন্তু তার একাংশও নিজে ভোগ করতে পারেননি কারণ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস বা অধিকার তার ছিল না। আমার দাদাই সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। অনেকে বলবে এসব আগের আমলের কথা। এই আমলের প্রসঙ্গে বলতে গেলেও এরকম কয়েকটা উদাহরণ দিতে পারব। আমার পরিচিত একজন পিতার সম্পত্তির বড় একটা অংশ পেয়েছিলেন। বিয়ের পর সেসব দেখাশোনা করত তার স্বামী। লোকটা বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ীক অনটনের কথা বলে সেসব সম্পত্তির বেশিরভাগই বিক্রি করিয়েছিল। এখন নারীটির সেই অর্থে নিজে চলার মতো কোন সম্পত্তি অবশিষ্ট নাই। এদিকে স্বামী আরেকটা বিয়ের জোগাড় করে ফেলেছে। সেই নারীর এসব মেনে নিতে হচ্ছে কারণ তার যাওয়ার কোন জায়গা নাই। সম্পত্তির ভাগ কড়ায়গণ্ডায় সব বুঝে নেয়ার ফলে ভাইদের বাড়িতেও তিনি উঠতে পারছেন না। আমার আরেক নারী সহকর্মীকে চিনি যিনি বেতন পেয়েই পুরা টাকা স্বামীর হাতে ধরিয়ে দেন। এখানে অনেকেই বলবেন, অনেক পুরুষই বেতনের সবটা টাকা স্ত্রীর হাতে দিয়ে দেন। সেটাও ঠিক না। নিজের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার নিজের মতো কিছু বন্দোবস্ত থাকা উচিত।

এখন আলোচনার সবচেয়ে বড় বিষয়বস্তু হওয়া উচিত, পরিবারের সদস্য হিসেবে খাদ্য, শিক্ষা, মতামত প্রকাশ এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে নারীর পূর্ণ অধিকার এবং স্বাধীনতা। সেটা বড় একটা সামাজিক আন্দোলন। সেটা আইন করে নির্ধারণ করা সম্ভব না। আপনি আইন করে বলপূর্বক সম্পত্তির ভাগ সমান করতে পারবেন; কিন্তু আইন করে কোন পিতা, ভাই বা স্বামীকে কন্যা, বোন বা স্ত্রীকে সম্মান প্রদর্শন করতে বা তাকে সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা দিতে বাধ্য করতে পারবেন না। আপনি আইন করে কোন মা বা শ্বাশুড়িকে বাধ্য করতে পারবেন না তারা যেন কন্যা এবং পুত্রবধূকে পরিবারের ছেলে সন্তানের সমান খাবার দেয়। সামাজিক বিধিনিষেধের বেলাতেও একই কথা খাটে। এই আধুনিক বিশ্বেও আমাদের দেশের কয় শতাংশ নারী নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে সক্ষম, কতজন নারী সেই সাহস অর্জন করেছেন? কতজন নারী নিজের সম্পদ আর সম্পত্তির বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? কতজন নারী সেসব নিজের মতো করে ভোগ দখল করতে পারেন? সেই প্রশ্নটা সবচেয়ে বড় এখানে।

শহরের শিক্ষিত বা প্রগতিশীল পরিবারের গুটিকয়েক নারীর অবস্থা বা অবস্থানের সাথে সারা বাংলার অভাগা নারীদের অবস্থা গুলিয়ে ফেলা যাবে না। সমাজের মানুষ হিসেবে নারীরা বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত। সবার সামর্থ্য, সক্ষমতা আর সম্পদ একরকম না, সবার সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থান একরকম না। সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করতে হলে এসব মাথায় নিয়ে কাজ করতে হবে। তাই বলে কি নারী সম্পত্তিতে সমান ভাগ পাবে না? অবশ্যই পাবে, এটা জন্মসিদ্ধ অধিকার বলে আমি বিশ্বাস করি।

কিন্তু, সম্পত্তি রক্ষার কৌশলও নারীকে শিখতে হবে। এই আলাপটাই জরুরি সবচেয়ে। নারীর আগে নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস ও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। পিতা-মাতার দেখভাল করার মতো সামাজিক পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। নারী শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে শতভাগ এবং সেটা কেবল কাগজে-কলমে নয়, হাতে-কলমে। মানে ব্যবহারিক। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মূল্যবোধসম্পন্ন স্বাধীন মানুষ তৈরি করা, আমি সেই ব্যবহারিক শিক্ষার কথা বলছি। এখানেই কর্তব্যের প্রশ্ন এসে পড়বে। নারী স্বাধীন না হলে নিজের পিতা মাতা বা পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালন করা তার জন্য সম্ভব হবে না। এখন আমি পিতার সম্পত্তির অর্ধেক নিয়ে নিলাম কিন্তু বিপদে আমার পিতা বা মাতাকে সাহায্য করতে পারলাম না, সেক্ষেত্রে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকলাম, এটা হতে পারে না। পিতা নিজের রক্ত পানি করে যে সম্পদ গড়েছেন, সেটা যেন স্বামীর বা নারীর নিজের স্বেচ্ছাচারিতায় নষ্ট হয়ে না যায়, সেই শিক্ষাটা নারীর জন্য সবচেয়ে দরকারি।

মূল কথা, নারীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পিতা-মাতার মাথার মধ্যে প্রথমে ছেলে সন্তানের সমান অবস্থান নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তারপর, যেকোন পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থানে দৃঢ থাকার সক্ষমতা ও সাহস অর্জন। তারপর, নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য বিষয়ে পূর্ণ সচেতন হওয়া। তারপরে গিয়ে সম্পত্তিতে সমান ভাগ দাবি করা। পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগ পাওয়া কোন অর্জন নয়, এটা জন্মসিদ্ধ অধিকার। কিন্তু সেই সম্পত্তি ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা, সেটার যথাযথ ব্যবহার ও প্রয়োজনে তা বৃদ্ধি করার সক্ষমতা হলো নিজের অর্জন। সম্পত্তিতে সমান অংশ পাওয়ার আগে এই অর্জনের বিষয়ে ভাবনা তৈরি হওয়া সবচেয়ে জরুরি। এই ভাবনার স্তরে যেতে পারে এরকম নারী তৈরি করা সবচেয়ে জরুরি। এটা আইন করে হতে পারে না। আইন তার নিজের গতিতে চলবে, তবে নারীর নিজের অবস্থান নিশ্চিত করার লড়াই আইনের ঊর্ধ্বে। সেটা দীর্ঘদিনের লড়াই, এটা বাহ্যিক নয়, নারীর অন্তর্নিহিত লড়াই। এখানে সবচেয়ে বড় অস্ত্র প্রকৃত শিক্ষা।

পিতা-মাতার কাছে এজন্য আমার দাবি, কন্যার ভালো খাদ্য, বস্ত্র আর সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি কন্যার যেন প্রকৃত শিক্ষা অর্জন হয়, সেটা নিশ্চিত করা। অশিক্ষিত কন্যার হাতে সম্পদ দিয়ে তাকে বরং আরো বিপদে ঠেলে দেয়া হয়।

রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর সমমর্যাদা এবং গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত মোট আসন সংখ্যার ৬০০ এর মধ্যে কমপক্ষে ৩০০ আসনের কাছাকাছি আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব দিয়েছে নারী সংস্কার কমিশন। অসম রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অবহেলিত শ্রেণিকে সুযোগ দিয়ে সামনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহাতীতভাবে জরুরি পদক্ষেপ। তবে, এই ব্যবস্থাকেও স্থায়ী ব্যবস্থা বলে মনে করি না, এটা সাময়িকভাবে নারীর জন্য সুযোগ তৈরি করে দিলেও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে যোগ্য এবং জনপ্রিয় লোকের অবমূল্যায়ন হবার আশংকা এখানে থেকে যায়।

নারী আসন বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সংসদে পুরুষের সমান সংখ্যক নারী প্রতিনিধি সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে আসবেন। নির্বাচন এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে যোগ্য এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ করা উচিত। এখানে নারী-পুরুষের সমান সংখ্যক হবার সুযোগ তৈরির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যারা নির্বাচনে অংশ নিবেন তারা আইন প্রণয়নের বিষয়ে কতটা সচেতন এবং ওয়াকিবহাল। সংসদের সদস্যপদ নির্ধারিত হওয়া উচিত এই মাপকাঠির ভিত্তিতে, সুযোগ তৈরির মাধ্যমে নয়। সেখানে পুরুষের চেয়ে নারীদের যোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা বেশি থাকলে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বেশি হলে ক্ষতি কি?

এই প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন আসতে পারে, আমাদের সমাজে কি এই অবস্থা এখনও তৈরি হয়েছে যে নারী ও পুরুষের মধ্যে বেছে নেয়ার সুযোগ থাকলে মানুষ নারীদের বেছে নিবেন? একদম নাই, এখনও নারীকে পুরুষের চেয়ে সবক্ষেত্রেই তুলনামূলক অযোগ্য এবং অদক্ষ ভাবা হয়, যদিও নারী সর্বক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখে যাচ্ছে।

আমার মূল কথা আসলে এখানেই, নারীর ব্যাপারে সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা খুবই অন্তর্নিহিত বিষয়। এখান থেকে উত্তরণ হবে ভেতর থেকেই। নারীর নিজের যোগ্যতা আর সক্ষমতার ব্যাপারে নিজের ভেতর থেকেই তার উপলব্ধি আসতে হবে। আমাদের সমাজে এখনও নারীর ব্যাপারে কেবল পুরুষরা বিদ্বেষ লালন করেন, এমনটা নয়। বরং নারীরাও নিজেদের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে বিদ্বেষ ও অনাস্থা লালন করেন। পুরুষতান্ত্রিকতা ধারণ করেন, এরকম নারীর সংখ্যাই আমাদের সমাজে বেশি। পুরুষদের প্রতি এসব নারীদের যে শ্রদ্ধাবোধ ও আস্থা, স্বজাতির একজন মানুষের প্রতি সে আস্থা তাদের নাই। এটা পারিবারের ভেতরে এবং কর্মক্ষেত্রে স্পষ্ট। আসলে নারীর জীবনমান, সমাজের নারীর অবস্থান সংস্কার তাই অনেকটাই নির্ভর করে নারীর নিজের চিন্তা-চেতনার সংস্কারের ওপরে। আইন নিজের গতিতে চলুক, তার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য ঘরে ঘরে নারীরা নিজেদের সংস্কার করে প্রস্তুত হোক আগামীতে বড় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে, বড় কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করতে।

মারিয়া সালাম: সাংবাদিক ও লেখক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ