যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন
বিশ্ব তাকিয়ে আছে ৫ নভেম্বরের দিকে
আর মাত্র কয়েকদিন বাকি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের। এ নিয়ে টানটান উত্তেজনা চলছে দেশটিতে। সব মিডিয়া বলছে, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই জমে উঠেছে। এ মুহূর্তে দুই প্রার্থী এবং দলীয় প্রচারকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সুইং স্টেট, অর্থাৎ যে রাজ্যগুলো যে কোনো দিকে ঝুকতে পারে সেই রাজ্যগুলোতে। আরেকটু খুলে বললে, ২০১৬ সালে যে রাজ্যগুলো ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জয়ী করেছিল, অথচ ২০২০ সালে এসে বাইডেনকে জয়ী করেছে সেই স্টেটগুলোতে অধিক মনোযোগী হয়েছেন দুই প্রার্থী।
এবার এই বিশাল দেশটিতে অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, পেলসিলভানিয়া এবং উইসকনসিন সুইং স্টেট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে সুইং স্টেটগুলো কী করবে, তা এখনো পরিষ্কার না। উল্লেখ্য, মোট কয়টি সুইং স্টেট হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ওপরের ওই রাজ্যগুলো গত নির্বাচনে মত পরিবর্তন করেছিল। এবারের নির্বাচনে এর কম-বেশি হতে পারে। ১৯৯২ সালে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ও প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ সিনিয়রকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন বিল ক্লিনটন। তখন ২২টি রাজ্য তাদের মত পাল্টেছিল। ওই ২২টি ছিল সুইং স্টেট।
এবারের ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান লড়াইয়ের আরেকটি নজর পড়ার মতো বিষয় হলো, বেশ কিছু রিপাবলিকান উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিক ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দিচ্ছেন প্রকাশ্যে, আবার কিছু ডেমোক্র্যাট নেতা ট্রাম্পকে। যেমন রিপাবলিকান দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী লিজ চেনি সরাসরি ট্রাম্পের বিরোধিতা করছেন। আবার ডেমোক্র্যাট ন্যাশনাল কমিটির ভাইস চেয়ার তুলসি গ্যাবার্ট সরাসরি ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন। তিনি কমলা হ্যারিসকে ‘বিপজ্জনক হিপোক্র্যাট’ বলে মন্তব্য করেছেন। এরকম ঘটন সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে দেখা যায় না। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এমন কোনো নিয়ম নেই যে, নিজের দলের প্রার্থীকে সমর্থন দিতেই হবে। সেদেশে রাজনীতিতে ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত। সেখানে বাংলাদেশের মতো কোনো ৭০ ধারা নেই যে, দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। এখানেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির সৌন্দর্য্য, পররাষ্ট্রনীতিতে যাই থাক না কেন।
টানটান উত্তেজনা শুধু যুক্তরাষ্ট্রে না, প্রায় গোটা বিশ্বব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন আধুনিককালে সব দেশের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু এবারের নির্বাচন অনেকের কাছেই বাঁচা মরার লড়াইয়েরে মতো। বহু দেশের অভ্যন্তরীণ ভাগ্য এই নির্বাচনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপের বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কিছু প্রভাব থাকে। ইউরোপের রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক একটি যোগসূত্র রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। শত হলেও ইউরোপ থেকে যাওয়া মানুষদের হাতেই তো আধুনিক যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্টি। তারপরও এবারের নির্বাচনে ইউরোপ মরিয়া হয়ে উঠেছে, যে করেই হোক কমলা হ্যারিসকে তারা প্রেসিডেন্ট দেখতে চায়। ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় না এলে ইউরোপ রীতিমতো নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে বলে তারা মনে করছে। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যেই বারবার বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো সদস্য পদ থেকে সরে আসতে পারে। সেটা না এলেও বা সম্ভব না হলেও ট্রাম্প যে ন্যাটোর জন্য বিশাল বাজেট বন্ধ করে দেবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এই বিষয়টিই ইউরোপকে ভাবিয়ে তুলেছে।
অলিখিতভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি সহনশীল বলে ডেমোক্র্যাট এবং ইউরোপিয়রা মনে করে। ২০১৬ সালে ট্রাম্পকে নির্বাচিত করতে রাশিয়া নাকি সহায়তা করেছিল। আবার কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের সময় ট্রাম্প নাকি গোপনে পুতিনকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছিলেন। এ অভিযোগ খোদ ডেমোক্র্যাট দলের। বিষয়টি শুধু এখানেই আটকে নেই। পুতিন বারবার বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধ থেমে যাবে। তার মানে সবাই ধরে নিয়েছেন ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে রাশিয়ার দখলকৃত ইউক্রেনীয় এলাকা ছেড়ে দিতে চাপ দেবেন ইউক্রেনকে। কথাটা একেবারে মিথ্যা না। তিনি কোনোক্রমেই ইউক্রেন যুদ্ধের পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে রাজি নন। আর এই যুদ্ধে যদি ইউক্রেন হেরে যায়, তাহলে সেটা ইউরোপের হেরে যাওয়ার শামিল হবে। ইউরোপের বড় প্রায় সব দেশই রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র, অর্থ দিয়ে ইউক্রেনকে সাহায্য করে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই তীব্র যে, এবার ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি অনেকটা সরাসরিই নেমে পড়েছে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিসের পক্ষে। সেটা যতটা না কমলাকে জয়ী করতে, তারচেয়ে বেশি ট্রাম্পকে ঠেকাতে।
যুক্তরাষ্ট্রে ল্যাটিন আমেরিকার ভোট অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রায় সাড়ে ৩ কোটি ভোটার কিউবা, মেক্সিকো, পোর্টোরিকো, ব্রাজিল এই সব দেশের বংশোদ্ভূত। অর্থাৎ মোট ভোটের ১৫ শতাংশ দক্ষিণ আমেরিকার থেকে আসা জনগণের। এদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ ভোটার বরাবর ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন দিয়েছে। তবে ট্রাম্প অভিবাসনবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও এবার সম্ভাবনা আছে রিপাবলিকানদের দিকে ল্যাটিনো ভোটারদের ঝুঁকে পড়ার। এর কারণ ট্রাম্প অর্থনীতি ভালো করার এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের কথা বারবার বলছেন। তাছাড়া ল্যাটিন আমেরিকান ভোটারদের মধ্যে তাদের দেশ থেকে লোক যুক্তরাষ্ট্রে আসতে পারবে না এমন সেন্টিমেন্ট কম।
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় আছে ৪০ লাখের বেশি। এই ভোটারদের মধ্যে রিপাবলিকান সমর্থকই বেশি। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাট দলের সমর্থন কমেছে মুসলিম ভোটারদের মধ্যে ইসরায়েলের গাজায় ও লেবাননে অভিযান ও হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার কারণে। অন্যদিকে ইহুদি জনগোষ্ঠীর সসমর্থন রয়েছে ট্রাম্পের দিকে। এতকিছুর পরও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর একটি প্রধান কারণ ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আচরণ ও মুখ ফসকে নানা কথা বলে ফেলা। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে নির্বাচনের পর ৬ ফেব্রুয়ারি ওভাল অফিস আক্রমণের অভিযোগ রয়েছে। একের পর এক নারীর শ্লীলতা হানির অভিযোগ, এবং কর ফাঁকি দেয়া।
অনেকে বলছেন, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে এবার দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন না। কারণ এবারই তার শেষ টার্ম, তিনি সেটা ভালো করেই জানেন। আবার একথাও সত্য, বিগত প্রায় ১৫ বছরের মধ্যে একমাত্র ট্রাম্পের চার বছরের মেয়াদকালে বিশ্বে যুদ্ধ বিগ্রহের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে কম। বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইনভলভমেন্ট ছিল সবচেয়ে কম। সবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। নিঃসন্দেহে এই সব নেতা চাচ্ছেন ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়ে আসুক।
আবার কিছু ক্ষেত্রে ডিসাইসিভ যুদ্ধের সম্ভাবনাও দেখা দেবে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে। যেমন ইসরায়েল সর্বাত্মক লাইসেন্স পাবে ইরানে হামলার। এ ছাড়াও ছোট কিছু দেশ আছে যেসব দেশে ডেমোক্র্যাট দলের প্রভাব রয়েছে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে সেসব দেশ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যেতে পারে। অনেকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যেই প্রেসিডেন্ট হোক না কেন, পররাষ্ট্র নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসে না। এই কথা মোটেই ঠিক নয়। বিশেষ করে ট্রাম্পের বেলায় তো নয়ই। বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও অর্থনৈতকভাবে দুর্বল দেশের ব্যাপারে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি যে পাল্টাবে, এত কোনো সন্দেহ নেই। তাই বিশ্বব্যাপী মানুষ মুখিয়ে আছে মার্কিন নির্বাচনে কী হয়, তা দেখার জন্য। আগামী ৫ নভেম্বর শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গতি প্রকৃতির কী হবে, তা নির্ধারণের দিন বলেই অনেকে মনে করছেন।
মহসীন হাবিব: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে