Views Bangladesh Logo

বইমেলায় পাণ্ডুলিপি যাচাইকে ‘পুলিশি হস্তক্ষেপ’ বলছেন লেখক-প্রকাশকরা

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আজ শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা ২০২৫। এবারের বইমেলার মূল প্রতিপাদ্য- ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ।’

বইমেলা শুরুর আগেই গতকাল (৩১ জানুয়ারি) থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক বক্তব্য ঘিরে চলছে তুমুল সমালোচনা। বইমেলায় প্রকাশের আগে বইয়ের পাণ্ডুলিপি যাচাই চায় পুলিশ। পুলিশের ভাষ্যমতে, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে- এমন বিষয়বস্তু ঠেকাতে মেলায় বই প্রকাশের আগেই পাণ্ডুলিপি যাচাই করতে বাংলা একাডেমিকে বলেছে পুলিশ।

বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। অধিকাংশ লেখক ও প্রকাশক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। লেখকরা এটাকে ‘পুলিশি হস্তক্ষেপ’, ‘নব্য ফ্যাসিজম’ ও ‘মধ্যযুগীয়’ বলে অভিহিত করেন। ‘বাস্তবসম্মত নয়’ বলে উল্লেখ করেছেন প্রকাশকরা।

বিষয়টিকে অভিনব উল্লেখ করে কবি মজিদ মাহমুদ বলেন, এই চাওয়াটি আসলে একটু অভিনব। কারণ আগে ঠিক এ ধরনের চাওয়ার কথা আমার জানা নেই। তিনি বলেন, বাংলা একাডেমির এ ধরনের অথরিটি আছে কী না, কোনো লেখকের বই প্রকাশের আগে বই যাচাই করবে। তা ছাড়া তাদের সক্ষমতা ও জনবলও তো নেই।

মজিদ মাহমুদ বলেন, বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি কিছু কিছু বইয়ের প্রতি বিতর্ক তৈরি হয়। মেলা থেকে প্রত্যাহার করা হয়, বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বই প্রকাশের দায়ে প্রকাশককে স্টলে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে এমনকি ওই লেখককেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও এগুলো কোনটিই বইয়ের ক্ষেত্রে বাঞ্ছনীয় নয়।

মজিদ মাহমুদ বলেন, প্রতিটি সরকার রাজনৈতিক যে বয়ান তৈরি করে, সেটির বিরুদ্ধাচরণ কোনো সরকারই আসলে চায় না। বিষয়টিকে লেখকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ উল্লেখ করে মজিদ মাহমুদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের বাইরে থাকা অবস্থায় লেখকের স্বাধীনতার কথা বললেও ক্ষমতায় আসার পর এটা দেখতে পাওয়া যায় না; কিন্তু প্রকৃত লেখক যারা, তাদের জন্য এসব বাধা কাজে আসে না।

এ ধরনের বিষয়ের ঘোরতর বিরোধিতা করেছেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার। বিষয়টিকে ‘সাহিত্যে পুলিশি হস্তক্ষেপ’ উল্লেখ করে জাকির তালুকদার বলেন, মেলা শুরু হওয়ার একদিন যখন বাকি এই সময়ে পাণ্ডুলিপি বা প্রকাশিতব্য বই দেখতে চাওয়ার কোনো অর্থ আছে বলে মনে হয় না। সাহিত্যিকের সাহিত্যমূল্য বোঝার জন্য পুলিশি হস্তক্ষেপের সবসময় বিরোধিতা করি। লেখক যদি আপত্তিকর কিছু লেখেন, তার বিপরীতে আরেকটি বই লিখবেন।

খবরদারি বা সেন্সরশিপের বিরোধিতা করে জাকির তালুকদার আরও বলেন, এটা অনেক আগেই মিটে যাওয়া প্রসঙ্গ। সাহিত্য সাহিত্যিকের হাতেই থাকবে। এখানে অন্য কোনো খবরদারি বা সেন্সরশিপ আমরা কখনো চাইনি। এতে লেখকের স্বাধীনতা মত প্রকাশের স্বাধীনতা মুক্তচিন্তার অধিকার ক্ষুণ্ন করবে। আগেও যেমন এ ধরনের প্রচেষ্টা কোনো কাজে আসেনি। এবারও এই প্রচেষ্টা কোনো লাভ হবে না। হয়তো কিছু লেখককে হয়রানি করা যাবে এই আর কি।

এটার মধ্যে নতুন কোনো ফ্যাসিজম দেখতে পান কী না- এমন প্রশ্নের উত্তরে জাকির তালুকদার বলেন, অবশ্যই, এটা তো ফ্যাসিজমেরই অংশ। আমরা তো একটি দলকে চিহ্নিত করে দিয়ে মনে হয়েছে, সারা দেশের সবাই দায়মুক্তি পেয়ে গেছি; কিন্তু চারপাশে কত ফ্যাসিস্ট ঘটনা যে ঘটে চলছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। এই যে আমাদের মাজারগুলো ভাঙছে, মানুষকে তাদের মতো করে ওরশ উদযাপন করতে দেওয়া হচ্ছে না। মেয়েদের খেলতে দেবে না- সেগুলো প্রতিরোধ না করে, যারা এগুলো করছে, তাদের গ্রেপ্তার না করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে প্রকারান্তরে তো ফ্যাসিজমকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটা একেবারেই বাস্তবসম্মত নয়। বইয়ের পাণ্ডুলিপি যাচাই করে মেলায় প্রদর্শন করা যাবে, এরকম আমার জানা নেই আর এটা যদি করতেও হয় এটার জন্য যে পরিমাণ লোকবল দরকার, সেটা কি বাংলা একাডেমির আছে? সেই সময় কি আছে?’

লেখক মঈনুল আহসান সাবের ফেসবুকে এ-সংক্রান্ত একটি লিংক শেয়ার করে ক্যাপশনে লেখেন ‘ভাগ্যিস, হয় না বলে, লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছি।’

লেখক ও অনুবাদক আলম খোরশেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটা অকল্পনীয় এবং একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তাহলে তো বাকস্বাধীনতা তথা সাহিত্যিক, শিল্পী, চিন্তকদের চিন্তা ও সৃষ্টির স্বাধীনতা বলে আর কিছু থাকবে না। আর সেটা আমাদের সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষকে বিঘ্নিত করবে প্রবলভাবে। না, এটা মেনে নেওয়া যায় না কিছুতেই।’


এ বিষয়ে কবি ও কথাশিল্পী মাহবুব আজীজ বলেন, "এ ধরনের প্রস্তাব স্তম্ভিত হওয়ার মতো ঘটনা। কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন কেউ এ ধরনের প্রস্তাব করতে পারে না। লেখকের স্বাধীনতায় এ ধরনের হস্তক্ষেপের প্রস্তাব ইতিহাসে কোনো দেশে কোনো শাসনকালে কখনই ঘটেনি। আশাকরি সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে না।"


বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. সরকার আমিন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলা একাডেমিকে পুলিশের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে কিছু জানানো হয়নি। নীতিমালা অনুসারে বইমেলা চলবে।’

প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাতসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সেখানে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মেলায় প্রকাশের আগে বইয়ের পাণ্ডুলিপি যাচাই চায় পুলিশ।

এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, এর আগে বইয়ের কনটেন্ট নিয়ে মেলায় সমস্যা হয়েছে, এমন পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশের কোনো উদ্যোগ আছে কি না? জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘আমরা বাংলা একাডেমিকে রিকোয়েস্ট করেছি, এ রকম কোনো বই যেন মেলায় না আসে, যেখানে উসকানিমূলক কথা বা লেখা আছে। এটা যেন ওনারা স্ক্যানিং করেন, ভেটিং করে স্টলে উপস্থাপন করেন। আমি আশা করি, তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবেন।’

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এবার বাংলা একাডেমিকে সাজেস্ট করেছি, আগামীতে নতুন যে বইগুলো প্রকাশিত হবে, তার পাণ্ডুলিপি আগেই যেন বাংলা একাডেমিতে জমা দেয়া হয়। তারা এটা যাচাই-বাছাই করবে, পড়ে দেখবে…। আশা করি, আগামী বছর থেকে এটা আমরা করাইতে পারব বাংলা একাডেমিকে দিয়ে, বই প্রকাশের আগে পাণ্ডুলিপি তাদের দিতে হবে। তারা অনুমতি দিলেই সেটা শুধু প্রকাশ হবে।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ