Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ব্যাংকিং খাত

বছরজুড়ে নেতিবাচক আলোচনা, শঙ্কা ছিল আমানত হারানোর

Rasel Mahmud

রাসেল মাহমুদ

বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

নিয়ম, খেলাপি ঋণ, নামে-বেনামে অর্থ লোপাটসহ নানা কারণে বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল ব্যাংকিং খাত। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের লুট, দখলদারিত্ব, অর্থ পাচারসহ জুলাই-আগস্টের আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন, বেসরকারি ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দেয়া, সরকারি ব্যাংকের শীর্ষ পদে পরিবর্তন, তারল্য সংকটে গ্রাহকদের চাহিদামতো অর্থ সরবরাহ করতে না পারায় পুরো খাতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তবে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দেয়ায় বছর শেষের আগে পাখা মেলে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে দেশের চিহ্নিত কিছু ব্যবসায়ী নামে-বেনামে শেয়ার কিনে একাধিক ব্যাংকের মালিকানায় আসে। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ অন্যতম। তারা শুধু মালিকানা নিয়েই থেমে থাকেননি; বরং ঋণের নামে অর্থ লোপাট করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে সেসব অর্থ পাচার করেছেন। বিষয়গুলো চাপা থাকলেও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর সেগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। এরপর শুরু হয় অস্থিরতা। প্রতিযোগিতা শুরু হয় আমানত তুলে নেয়ার। এতে সংকট প্রবল হয়।

তবে অর্থ লুটপাটসহ নানা অনিয়ম খতিয়ে প্রকৃত চিত্র বের করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক খাতের সংস্কারে গঠন করা হয়েছে টাস্কফোর্স; যা খাত সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার ফল। তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে ও আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ১১টি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টার হয়ে তারল্য সহায়তা দেয়। ফলে ধীরে ধীরে সংকট কাটছে।

অর্থনৈতির শ্বেতপত্র প্রণয়নে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে দেশে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতের সমস্যাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বীকৃত খেলাপি ঋণ ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। পুনঃতপশিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ ২ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। ঋণ অবলোপন হয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকার। এ ছাড়া বছর শেষে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি নতুন নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। এমন সব আলোচনার মধ্য দিয়েই কেটেছে ২০২৪ সাল।

বোর্ড পুনর্গঠন


৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে পরিবর্তন আসে। দায়িত্ব পান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি দায়িত্ব নিয়েই আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্বল ব্যাংকগুলোর বোর্ড ভেঙে দেন। ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলো এস আলমের দখলে ছিল। এর বাইরে ইউসিবি, এক্সিম ব্যাংক এবং আইএফআইসি ব্যাংকের বোর্ডও পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা


গভর্নরের দায়িত্ব নেয়ার পর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, টাকা ছাপিয়ে আর দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দেয়া হবে না। তবে তিনি সেই কথা রাখতে পারেননি। প্রথমে সবল ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংককে গ্যারান্টার রেখে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেয়। তাতে সংকট না কাটায় শেষ পর্যন্ত টাকা ছাপিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংককে দেয়া হয় ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

টাস্কফোর্স গঠন


আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ, প্রধান ঝুঁকিগুলো নিরূপণে গঠন করা হয় টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্স দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি নিরূপণ, তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদকে পৃথকীকরণ-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, টাস্কফোর্স সংকটকালীন প্রতিঘাত সক্ষমতা অর্জনে ব্যাংকের সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার প্রক্রিয়ার আওতায় নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার উন্নয়ন, ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক ও করপোরেট প্রভাব সীমিত করা, ব্যাংকের মালিকানা সংস্কার ইত্যাদি-সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করবে।

সমস্যায় থাকা ব্যাংকের অর্থ উদ্ধার এবং বিধিকাঠামো ও সংশ্লিষ্ট নীতিমালা প্রস্তুত করা, দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য বিভিন্ন নীতিগত ব্যবস্থা বা পদক্ষেপও গ্রহণ করবে এই টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্স থেকে ‘দ্য স্পেশাল রেগুলেশনস অব বাংলাদেশ ব্যাংক-২০২৪’ নামে একটি নীতিমালা জারি করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকের সম্পদ মূল্যায়নে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দিতে পারবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ মূল্যায়ন করে প্রকৃত মূলধনের প্রয়োজনীয়তা বের করা এবং দুর্বল হওয়া ব্যাংকের অবস্থার উন্নয়ন করাই এই পরামর্শক নিয়োগের মূল উদ্দেশ্য।

তিন শতাধিক হিসাব জব্দ


অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তিন শতাধিক ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সন্দেহজনক লেনদেন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে এসব হিসাব জব্দ করা হয়। এসব হিসাবে আটকে আছে ১৫ হাজার কোটি টাকা।

রেমিট্যান্স প্রবাহ


আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সেই রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেকটাই বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে দেশে ১ হাজার ১১৩ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। জুলাইয়ে রেমিট্যান্স ২০০ কোটি টাকার নিচে এলেও আগস্ট থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের বছর একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৮৭৯ কোটি মার্কিন ডলার। আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ডিসেম্বর মাসের ২১ দিনে দেশে বৈধপথে রেমিট্যান্স এসেছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি।

ডলারের বিনিময় হার


চলতি বছরের শুরু থেকেই অস্থির হয় ডলার বাজার। তবে নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। তাতে ডলার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা দেখা যায়। ডলার বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ডলারের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের অধিকাংশ সময় দেশের ডলার বিনিময় হার ঘন ঘন পরিবর্তন হয়। সংকট কাটাতে ডলার বিক্রির মাধ্যমেও জোগান দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবুও ২০২৩ সালে ডলারের দাম বেড়ে আন্তঃব্যাংক ১১১ টাকা এবং খোলাবাজারে ১২৫-১২৬ টাকা বেচাকেনা হয়ে রেকর্ড গড়েছিল। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে ডলারের দর বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়, সর্বশেষ জুলাইয়ে ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১৮ টাকা। বছরের শেষভাগে ব্যাংকিং চ্যানেলেই ডলার বিক্রি হচ্ছে ১২৩ টাকা। খোলাবাজারে প্রতি ডলারের জন্য ১২৯ টাকা দিতে হচ্ছে।

রিজার্ভ


আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে দর নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন রিজার্ভ তলানিতে নেমে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি কমেছে। ২২ ডিসেম্বর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফের বিপিএম হিসাব অনুযায়ী তা ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার।

খেলাপি ঋণ


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ