উদ্বোধনী সংখ্যা ৪ : সম্ভাবনার বাংলাদেশ
তরুণরা হচ্ছে কাদামাটি, তাদের তৈরি করার জন্য দক্ষ কুমার দরকার
বাংলা ভাষার অন্যতম কথাশিল্পী সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একাধারে শিক্ষাবিদ, সাহিত্য সমালোচক ও লেখক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন চার দশকের বেশি সময়। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে (ইউল্যাব) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। এ ছাড়া তিনি জাতীয় জাদুঘর ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। সম্প্রতি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা ও শিক্ষাব্যবস্থার ধারা নিয়ে ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন এই শিক্ষাবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রণজিৎ সরকার।
ভিউজ বাংলাদেশ: সাহিত্যের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেন মধুর হয় না!
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: সবচেয়ে আদর্শ রাষ্ট্রের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক মধুর হয় না। রাষ্ট্র এবং সাহিত্য দুই জায়গায় থাকা উচিত। রাষ্ট্রের উচিত যদি গণতন্ত্রিক রাষ্ট্র হয়, তাহলে মানুষ চায় যে, সংস্কৃতিকে লালন করবে। কারণ রাষ্ট্র আসলে কিছুই না। মানুষের ইচ্ছার একটা প্রতিফলন। একটি কাঠামো মানুষের প্রতিফলন ঘটনার জন্য একটি সংসদ থাকে, কার্যকর সংসদ একটা বিচার ব্যবস্থা থাকে। সেটি সৎ বিচার করবে। ভুল বিচার করবে না। মানুষের অধিকার হরণ করবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকে, যে বাহিনীর মানুষের অধিকার পদদলিত করবে না, অধিকার রক্ষার চেষ্টা করবে এবং দুষ্টের দমন করবে, শিষ্টের পালন করবে–এই তো একটা আদর্শ রাষ্ট্র। সেখানেও দেখা যায়, পুলিশের হাতে মানুষ নির্যাতন হচ্ছে। পুলিশের হাতে আমেরিকায় একজন কৃষ্ণাঙ্গকে শরীরের রঙের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো।
জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসে সরকার। সরকার আসলে কিছুই না, জনগণের অজ্ঞাবহ হওয়া উচিত আদর্শিক রাষ্ট্রের; কিন্তু আমাদের আশপাশের কোনো রাষ্ট্রে যখনই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাাচিত সরকার আসে; তারা কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা মনে করে জনগণ তাদের আজ্ঞাবহ। এটা আসলে মানুষের মৌলিক স্খলন। এটা সব দেশেই আছে। সেখানে আদর্শ রাষ্ট্র অনেক সময় সাহিত্যের পরিপন্থি হয় অনেক সময়। কারণ সাহিত্য যে সত্য প্রকাশ করে। সেই সত্যগুলোর রাষ্ট্রের কাছে অপ্রিয় হতে পারে। সেই সাহিত্যের পথে রাষ্ট্র বাধা হিসেবে দাঁড়াতে পারে। সেগুলো আদর্শ রাষ্ট্র নয়, সেগুলোতে মুক্ত চিন্তাকে গলা টিপে ধরা হয় এবং সাহিত্য মুক্তচিন্তা বিচরণের ক্ষেত্রে।
ভিউজ বাংলাদেশ: সেদিক দিয়ে আমাদের রাষ্ট্র ও সাহিত্যের সম্পর্কে কোন দিকে অবস্থান করছে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: বাংলাদেশ সরকারের কাজ বা কথাবার্তা হয়তো সাহিত্যের পক্ষে বা লেখকদের স্বাধীনতার পক্ষে কিন্তু শেষ বিচারের যে কাঠামোতে সরকার নিজেকে স্থাপন করেছে, সে কাঠামো কোনো দিনই শিল্প সাহিত্যের সমর্থন যোগ্য নয়। এ কাঠামোতেই চলছে বাংলাদেশ। ১৯৭১-এর পর তাতে এখন পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন ছাড়াই। সেটা ছিল পাকিস্তানি কারাগারের। সেখানে কোনো পরিবর্তন বা আমাদের ওপর উপনিবেশের চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা সেই কাঠামোর মৌলিক কোনো পরিবর্তন করতে পারেনি। সব কিছুই আছে আগের মতোই। এ কাঠামোর যদি মৌলিক পবির্তন না হয়, তাহলে সে রাষ্ট্র বা সরকার কখনো সাহিত্যবান্ধব হতে পারে না।
ভিউজ বাংলাদেশ: ৫২ বছরের আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটুকু এগোল?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: মোটেও এগোয়নি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো মান্ধাতার আমলের হয়ে চলে আসছে। ইতিহাসনির্ভর, নোট বইনির্ভর, মুখস্থনির্ভর, এগুলো আমাদের শিক্ষার নানা উপকরণ। আমার একটা ধারণ হলো বাংলাদেশের শিক্ষার শত্রু হলো ঘরের ভেতরে। শিক্ষা কারিকুলাম ঘনঘন পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রথমত, আমাদের বাজেট বরাদ্দ নেই। শিক্ষা বিস্তার ঘটনার জন্য মানও বাড়তে হবে; কিন্তু সেটা নেই। শিক্ষায় বিনিয়োগ না করলে আমরা সেই শিক্ষা দিতে পারব কি করে।
ভিউজ বাংলাদেশ: বিজ্ঞান থেকে এক শ্রেণির শিক্ষার্থী তো বঞ্চিত হচ্ছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: যুদ্ধ কিন্তু আগামীতে সেনাবাহিনী করবে না। যুদ্ধ করবেন বিজ্ঞানীরা। ইতোমধ্যে দেখ, ড্রোন মানুষ চালায় না। এমন ড্রোন তৈরি হচ্ছে, সেগুলো রাডার দিয়ে। এক এক ড্রোন পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে পারবে। তাহলে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে বসে যুদ্ধ চালাতে পারবে। একটা সেনাবাহিনীর ভবিষ্যতের প্রয়োজন হবে না। এটা ভবিষ্যতের যুদ্ধ। তার মানে আমরা যুদ্ধ জাহাজ না কিনে এমন কিছু বিজ্ঞানী তৈরি করব, যারা যুদ্ধ জাহাজের পরিবর্তে ছোট ছোট কিছু অস্ত্র তৈরি করবেন।
বিশেষ করে চীন তো ডুব জাহাজ সম্পূর্ণভাবে ডুবিয়ে দিতে সম্ভব। বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর লোকজন বসনে। ফলে আমি মনে করি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন অবস্থায় পৌঁছাবে তখন বিপ্লব ঘটবে। আমাদের মেধার কিছু আদর্শ গত দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বিশাল শ্রেণির শিক্ষার্থী বিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে থেকে অনেকে মেধাবী ছাত্র এত সম্ভাবনাময় কিন্তু তারা ধর্ম পড়বে। তবে ধর্ম পড়াটা জরুরি। বিশেষ করে এই সময়ে যখন মানুষ নৈতিক শিক্ষা ভুলতে বসেছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: এখনকার তরুণ প্রজন্মের বিভিন্ন ইস্যুতে সফলতা যেমন আছে, তেমনি ব্যর্থতাও আছে, এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমি তরুণ প্রজন্মকে তো দোষ দিই না। যেমন একজন কুমার কাদামাটিকে বিভিন্ন রূপ দেখে, সে যেভাবে দেখে সেভাবে কাজ করে। কাদার তো দেশ দোষ নেই, কারণ যেভাবে কাদাকে রূপ দেওয়া যাবে সেভাবেই তৈরি হবে পাত্র। তরুণরা হচ্ছে সেই কাদা; কিন্তু সেই কুমার কোথায়। জেনে শুনে কাদার অপব্যবহার করে সে তো আসলে কুমারের যোগ্য না। জেনেশুনে তরুণদের মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দেন অগ্রজরা। তাদেরও তো সন্তান আছে। সেটা তারা ভুলে যান, যারা নকল ওষুধ দেন সে ওষুধ খেয়ে বাচ্চারা মারা যায়, সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। সমাজবিনষ্ট করছে বয়স্ক মানুষগুলো লোভে এবং স্বার্থের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: স্বাধীনতার ৫২ বছরে সাহিত্যের আন্তর্জাতিকভাবে কতটুকু জায়গা করে নিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কোনো লেখক যদি আন্তর্জাতিক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে লিখতে শুরু করেন তাহলে সে লেখক বেশি দূর যেতে পারবেন না। আন্তর্জাতিক হতে হলে আমাদের দেশের এখানে যদি পৃথিবীর দৃষ্টি আসতে হয় তাহলে কিন্তু প্রথমে দেশটা আসতে হবে অর্থনীতির মধ্য দিয়ে। আমাদের অনেক সাহিত্যিক আছেন। তাদের লেখা যদি ইংরেজি অনুবাদ হতো তাহলে অনেক দূর এগিয়ে যেতেন। ঢাকা লিট ফেস্টে নোবেল বিজয়ী আবদুলরাজাক গুরনাহ এর সঙ্গে কিছু সময় কথা হলো। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি লিখি। আমি বললাম, গল্প উপন্যাস লিখে। তবে গল্পটা লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তিনি বললেন, ভেরি চ্যালেঞ্জিং। বললাম, আমি গল্প লিখেই তৃপ্তি পাই।
ইংরেজিতে আমি লিখেছি কি না? বললাম না, আমার দেশের মানুষ যেটা পড়ে আনন্দ পায় সেটাতেই আমিও আনন্দ পাই। এমন একটা দিন আসবে আমার গল্পগুলো বিদেশিরা অনুবাদ করবেন, তিনি দেখি আমার কথাগুলো অ্যাপ্রিসিয়েট করলেন। সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের উৎস কমে গেছে, এখন সামাজিক যোগাযোগ ম্যাধম কিংবা বিউটিফুল হচ্ছে সংস্কৃতির জায়গা। যেগুলো বিভিন্ন ধরনের উগ্রতা ছাড়ায় সেগুলো লাখ লাখ মানুষ দেখছে। পাশাপাশি হাওয়া সিনেমার ‘সাদা সাদা’ গানটাও শুনে এই যে আমাদের একটা পরিবর্তন ধারা এসেছে। আর সংস্কৃতির লক্ষ্যের দ্বারা ঘুরে দাঁড়ানোর একটা লক্ষণ পাচ্ছে এটা শুভ দিক। এত বেশি আমলাতান্ত্রিক হলে দেশটার ভেতর এই তেজিভাবটা থাকে না। আমাদের সম্ভাবনা প্রচুর কিন্তু তরুণদের উগ্রতা কিছুটা আছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার দীর্ঘজীবনে কোনো অপূর্ণতা বা কিছু করার ইচ্ছা ছিল, যা করতে পারেননি?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: প্রতিদিন আমি নতুন করে উদযাপিত হই, নতুন করে শুরু হয় আমার জীবন। খেলাধুলাতে আনন্দ পেতাম, বিশেষ করে ক্রিকেট খেলায়। ক্রিকেটে আমার যথেষ্ট মেধা ছিল; কিন্তু পারি নাই, তাতে আমি দুঃখ পাই না, আমি মূলত একজন রসায়নবিদ হতে চেয়েছিলাম। নানান কারণে সেটা হতে পারেনি। হয়তো রসায়নবিদ না হওয়াটা আমার জন্য ভালোই লাগে, আবার দুঃখ লাগে বিশ্ববিদ্যালয় যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলাম সেটা পূরণ করতে পারিনি। অপূর্ণতা থেকে যায় আমি যা করতে চেয়েছিলাম তা করতে পারেনি। পরে আমি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছি, সে অর্থে আশা ভঙ্গের বেদনা তেমন নেই। করতে পেরে আনন্দিত তারপরও।
আমি স্বপ্নটা দেখিনি কিন্তু এটা দেখলে ভালো হতো। বাংলাদেশের সব জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছা ছিল আমার এখনো যাওয়া হয়নি। অনেক উপজেলা আছে যেখানে আমি আমার পা স্পর্শ করেনি। এটা আমার অক্ষমতা অনেক নদী আছে কিন্তু দেখা হয়নি। অনেক গাছ আছে চেনা হয়নি, আসলে এক জীবনে সবকিছু পূরণ করা সম্ভব না সেজন্য অনেকবার মনে হয় জন্ম নিতে হবে। অপূর্ণতা আছে একাত্তরে যে স্বপ্নগুলো দেখেছিলাম সেগুলো স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসেও পূরণ হয়নি। যাদের দেশপ্রেম ছিল সেই দেশপ্রেমিক ওনারা নেই। এখন ব্যক্তি প্রেম দেশপ্রেমকে ছাড়িয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়াটা এবং আমার ছোটবেলার বন্ধু শহীদ সুলাইমান কথা মনে পড়ে। কত অল্প বয়সে মারা গেল সেটা একটা অপূর্ণতা। যা পেয়েছি সন্তুষ্ট- শিক্ষক জীবনে ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসা পেয়েছি এটা আমার জীবনের বিশাল একটা প্রাপ্তি। আমার জীবনে প্রাপ্তির পরিমাণটাই বেশি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে ধন্যবাদ
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: তোমাকেও ধন্যবাদ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে