খেলাধুলায় তরুণরা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম; কিন্তু তাদের সুযোগ নেই
দেশের ক্রীড়াঙ্গনে যারা ‘ট্রেন্ড’ নিয়ে কাজ করেন তাদের পর্যবেক্ষণে নিয়মিতভাবে উঠে আসে বয়সভিত্তিক দলীয় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা এবং টুর্নামেন্টগুলোতে আমাদের ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন খেলায় দক্ষিণ এশিয়া, এমন কি আরও কিছুটা দূরে এশিয়ান লেবেলের কম্পিটিশনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সমানতালে আবেগ, সাহস এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। অন্য ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও দেশের যুবসমাজ অন্য দেশের যুবসমাজ থেকে পিছিয়ে নেই এটাই তার স্বাক্ষর বহন করে। এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সামর্থ্য ও সৃষ্টিশীলতার তো বিকল্প নেই।
ক্রীড়াঙ্গনে একদম তৃণমূল থেকে বেড়ে ওঠার পথে আছে বিভিন্ন ধরনের বাধা-বিপত্তি এবং দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব। আছে সচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের অভাব! দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল। ক্ষেত্র বিশেষে আছে অসক্ষমতা এবং বিভাজন। এ ছাড়া আছে হতাশাবোধ ও অসহযোগিতা। এতে করেই ক্রীড়াঙ্গনের বড় স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার বিষয়টি দেরি হচ্ছে। মেধা ও সম্ভাবনার অপচয় হচ্ছে। এই সম্ভাবনা এবং সম্পদ তো আর কয়েক বছর পর থাকবে না। ক্রীড়াঙ্গনে কোনো নীতিমালা নেই। আর তাই সংস্কার সাধনের উদ্যোগ গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে ক্রীড়াঙ্গনে কম বেশি স্থবিরতা নেমে এসেছে। পুরো ক্রীড়াঙ্গনকে না বুঝে হঠাৎ করে পরিবর্তনের উদ্যোগ ‘ব্যাক ফায়ার’ হয়েছে।
তরুণরা ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সক্ষমতার অধিকারী; কিন্তু তাদের সুযোগ নেই, তারা পারছেন না তাদের ইতিবাচক শক্তি এবং সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। তরুণরা ভয় পান না। তারা পরিবর্তনের জন্য ঝুঁকি নিতে পিছ পা হন না। তারা আত্মবিশ্বাসী কুসংস্কার ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে পাশাপাশি ঐক্যবদ্ধ। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তরুণদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের ক্রীড়াঙ্গন তো জানে না ১০ বছর পর কোথায় অবস্থান করতে চায়। ক্রীড়াঙ্গনে স্বপ্নের কথা কখনো কখনো উল্লেখ করা হয়; কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বাস্তবধর্মী পরিকল্পনার আওতায় ধাপে ধাপে তো এগোতে হবে। সেই পরিকল্পনা কোথায়? দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে এসব কিছুই ‘মিসিং’ আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের রূপ রেখায়।
ক্রীড়াঙ্গন তো সাময়িক কোনো বিষয় নয়। ক্রীড়াচর্চার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। ক্রীড়াচর্চার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের ভাবমূর্তি এবং সরাসরিভাবে জনস্বার্থ। ক্রীড়াঙ্গনে সমষ্টিগত ‘গোল’ কী? সবাই মিলে উচ্ছ্বাস করি যে ক্রীড়াঙ্গনকে ঘিরে এই ক্রীড়াঙ্গনের ‘ভিত’ যে বড় দুর্বল। আগেই উল্লেখ করেছি আমাদের তরুণরা বয়সভিত্তিক কম্পিটিশনগুলোতে ভালো করছেন। কথা হলো এর পরের স্তরে সিনিয়র লেবেলে কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো করতে পারছেন না। এখানে উল্লেখ করতে হবে বয়সভিত্তিতে যারা দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন এক সময় তারাই কিন্তু সিনিয়র পর্যায়ে কম্পিটিশনে পাল্লা দিয়ে মাঠে গড়াতে পারছেন না। এর পেছনে অবশ্যই যুক্তিসংগত কারণ আছে? এই কারণটি কখনো খুঁজে বের করে সিনিয়র লেবেলেও যাতে জাতীয় দল কম্পিটিশনে পিছিয়ে না পড়ে।
দেশবাসীকে বারবার হতাশা উপহার না দেয়- এ ক্ষেত্রে বাস্তবধর্মী উদ্যোগের বেশি প্রয়োজন আছে। সব দেশই এই ক্ষেত্রে ধর্মকর্ম পালনের মতো করে বিরামহীনভাবে কাজ করে। বয়সভিত্তিক দলের সঙ্গে সিনিয়র দলের অনেক পার্থক্য আছে। আর তাই এই ক্ষেত্রে উদ্যোগগুলো ভিন্নধর্মী এবং বাস্তবায়নের বিষয়টি সব সময় চোখ কান খোলা রেখে কাজ করতে হয়। এই ক্ষেত্রে ক্রীড়া ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ভিন্নধর্মী। এখানে আবেগ নয় যোগ্যতা। অতীতে কে কি করেছেন সেটি এখানে আলোচনার বিষয় নয়। এখানে সব ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব।
অতীতে কাজ করেছেন এখনো তার প্রয়োজনীয়তা আছে সেই ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই প্রসেসের সঙ্গে কাজ করার। এখন সব খেলাতে টেকনিক্যাল পারসনদের কাছ থেকে ক্রীড়াঙ্গনে নির্দিষ্ট খেলায় কি চাহিদা এটি তো কারো অজানা নয়। প্রতিটি দেশে সব খেলার টেকনিক্যাল পারসনদের ওপর আস্থা বিশ্বাস রাখে, কেননা তারা যোগ্য হিসেবে পরীক্ষিত বলে। আবার এ ক্ষেত্রে সব সময় কিন্তু ‘রেজাল্ট’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক খেলার জগতে রেজাল্ট দিতে না পারলে খোলা দরজা দিয়ে প্রস্থান করা ছাড়া উপায় নেই। এটি রূঢ় বাস্তবতা।
আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে ধাপে ধাপে প্রচুর অসংগতি আছে। আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন সৃষ্টি করতে পারিনি। ক্রীড়াঙ্গনে তরুণদের ঘিরে বাস্তবধর্মী উদ্যোগের মাধ্যমে পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে তরুণরা ভবিষ্যতের জন্য বড় স্বপ্ন দেখতে পারবেন এর ধারে কাছেও নেই আমাদের ক্রীড়াঙ্গন। বড় সমস্যা হলো সবকিছুকে হালকাভাবে নেওয়া। ক্রীড়াঙ্গন তো হালকাভাবে নেওয়ার ‘সাবজেক্ট’ নয়। এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, মূল্যবোধ এবং চেতনা তো অন্যরকম।
২০২০ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল যুব বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে ভারতকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ২০২৩ সালে যুব এশিয়া কাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। সেই ক্রিকেটে সিনিয়র লেবেলে (জাতীয় দল) আমাদের কি দেখতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক যুব হকিতে বাংলাদেশ যুব দলের পারফরম্যান্সের সঙ্গে সিনিয়র দলের পারফরম্যান্সের কি কোনো মিল আছে। ক্রিকেটে এবং হকিতে জাতীয় দলের পারফরম্যান্স কেনো আশাব্যঞ্জক নয়।
ফুটবলে একই অবস্থা। বয়সভিত্তিক দল ভালো করছে। মাঠে সাহস আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে লড়ছে, দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি নেই। সেখানে জাতীয় দলের পারফরম্যান্স নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। গত বছর সাফ অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে ভারতের অরুণাচলে অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে দাপটের সঙ্গে ফুটবল কেলে আমাদের যুব দল ফাইনালে উঠেছে। ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ১-১ গোলে সমতা থাকাতে খেলাটি টাইব্রেকারে গড়ায়।
আর এই টাইব্রেকারে যুবদল পরাজিত হয়েছে ৪-৩ গোলে। অর্থাৎ রানার্সআপ। খেলার শুরুতেই গোল খেয়ে যুব দলের খেলোয়াড়রা যেভাবে লড়ে খেলায় ফিরে এসেছেন তার প্রশংসা করেছেন ভারতের ফুটবল পণ্ডিতরা। টাইব্রেকারে ভাগ্য পরীক্ষা বিষয়টি একদম আলাদা। এখানে সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য দুটি পাশাপাশি রেখে বল শ্যুট করতে হয়। পুরোপুরি ওপর অলার কাছে আত্মসমর্পণ। প্রচণ্ড মানসিক চাপ।
ইকরামউজ্জমান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন, প্যানেল রাইটার ফুটবল এশিয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে