সলিমুল্লাহ খান
দেশ নিয়ে হতাশার কথা বললে আমার গলা টিপে দেবেন না
চতুর্থ পর্বের পর
এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলন আর জনযুদ্ধে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। এক, দুই, তিন করে এর মধ্যেই দেশটি পার করেছে স্বাধীনতার ৫২ বছর। রাষ্ট্রীয়ভাবে সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী; কিন্তু এই ৫২ বছরে একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কত দূর এগোলো। শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, বুদ্ধিজীবীতা সব কিছুতে কত পথ পাড়ি দিল বাংলাদেশ। এসব বিষয় নিয়ে দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও চিন্তক সলিমুল্লাহ খান-এর সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজ-এর বিস্তারিত কথোপকথন হয়েছে। সেই কথোপকথনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো। আজ শেষ পর্ব:
রাহাত মিনহাজ: আপনার সঙ্গে পূর্বের দীর্ঘ আলোচনায় হতাশার অনেক কথা শুনেছি। আপনি কি বর্তমান বাংলাদেশে আশার আলো কিছু দেখেন না?
সলিমুল্লাহ খান: অবশ্যই, এই যে দেশে আজকে এত বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, এটা আশার কথা। দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে, এটাও আশার কথা। করোনা মহামারিতে অনেক কম মৃত্যু হার নিয়ে আমরা বেঁচে আসতে পেরেছি, এটাও আশার কথা। অনেক আশা আছে; কিন্তু প্রত্যেকটি মানুষের স্বাস্থ্য কার্ড কেন থাকবে না? আমি কেন চিকিৎসা চাইলে চিকিৎসা পাব না? এই সব কথা যদি হতাশার হয়, তাহলে আমি হতাশার কথাই বলব।
রাহাত মিনহাজ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেন। আপনি কী মনে করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতের সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ ছিল?
সলিমুল্লাহ খান: ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার তাৎপর্য অনেক। ভারতবর্ষও কিন্তু বহুদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিধান্বিত ছিল? আমি একটা বইয়ের উদাহরণ দিই। শ্রীনাথ রাঘবন নামের এক ভারতীয় গবেষক ২০১৩ সালে একটি বই বের করেছেন। বইয়ের নাম ‘১৯৭১’। তাতে নাম লিখেছেন দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ। এই বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বহুদিন চিন্তা করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাদের একটা লাভ আছে আবার তাদের ক্ষতিও আছে। কারণ এতে অনেকেই স্বাধীন হতে চাইবে। বাংলাদেশ এক সময় নিপীড়িত, বঞ্চিত ছিল। যে দেশকে এখনো বিদেশি পণ্ডিতরা বলেন, এটা অসভ্য পাণ্ডববর্জিত দেশ। সেই পাণ্ডববর্জিত দেশকে বলা হচ্ছে আজকের পৃথিবীতে বাঙালিদের একমাত্র রাষ্ট্র। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমি জাতীয়তাবাদী নই। আমি গণতন্ত্রী; কিন্তু প্রত্যেক মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আমি স্বীকার করি। সেদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটা উদাহরণ।
রাহাত মিনহাজ: এ প্রসঙ্গে আরেকটু যদি বিস্তারিত বলেন...
সলিমুল্লাহ খান: যে অবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এটা অচিন্তিতপূর্ব। কারণ ইরাকের মতো দু-একটা দেশ বাদে, তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশ আমাদের (বাংলাদেশকে) তখন সমর্থন করেনি। কেন করেনি? কারণ সকলেই তখন ছিল রক্ষণশীল। একটা রাষ্ট্রকে ভেঙে আরেকটা রাষ্ট্র গড়া- তৃতীয় বিশ্বের লোকেরাই সমর্থন করেননি। এই যে তথাকথিত মুসলিম বিশ্ব বর্তমানে আমাদের সঙ্গে আছে, ১৯৭১ সালে তারা কেউ আমাদের সমর্থন করেনি।
রাহাত মিনহাজ: আমি যতদূর জানি, পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি হানাদারদা যখন আক্রমণ করছে, তখন এবং যুদ্ধের চূড়ান্ত দিনে অনেক মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়েছে। যদিও শেষ দিনগুলোতে বাংলাদেশের পরমবন্ধু ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সলিমুল্লাহ খান: ১৯৭১ সালে মার্কিন দেশ পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়েছে এটা আপনারা জানেন; কিন্তু চীনের তো জনগণের বন্ধু হওয়ার কথা ছিল। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে চীনও বাংলাদেশকে সমর্থন করতে পারেনি। চীন তখন আমেরিকার সঙ্গে খাতিরের চেষ্টায় ছিল। আমি এ জন্য বলতে চাচ্ছি, গরিবও অনেক সময় গরিবের বিরোধিতা করে। তবুও অপূর্ব এক অবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার।
বিশ্ব পরিস্থিতির নানা সুযোগ নিয়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি। যেমন ধরুন, রাশানরা যদি তখন ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি না করত, তাদের মধ্যে যদি বন্ধুত্বের চুক্তি না হতো, তারা যদি বারবার জাতিসংঘে ভেটো প্রয়োগ না করত, বাংলাদেশের যুদ্ধ হয়তো ভিয়েতনামের মতো দীর্ঘস্থায়ী হতো। এখন সোভিয়েত রাষ্ট্রের কথা সকলেই ভুলে গেছেন। আমি ভুলতে চাই না। সোভিয়েতরা ইচ্ছে করেই হোক, অনিচ্ছাতেই হোক, জাতিসংঘে তারা যদি ভেটো না দিতো, তাহলে কিন্তু আমেরিকানদের প্রস্তাব গৃহীত হতো। এমনকি যুদ্ধ বন্ধ করতে সর্বশেষ ১৪ ডিসেম্বর নাগাদ পোল্যান্ড একটা প্রস্তাব তুলেছিল। যার মূল কথা ছিল, যার যার সৈন্য নিজ দেশে চলে যাবে। এ প্রস্তাব পাস হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঝুলে থাকত।
রাহাত মিনহাজ: তাহলে বাংলাদেশ ঠিক কীভাবে স্বাধীন হলো। মূলত কাদের সংগ্রাম, আত্মত্যাগে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে?
সলিমুল্লাহ খান: আমি মনে করি, বাংলাদেশ দুই কারণে স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ লড়াইটা করেছে। জনগণ মানে কৃষক সমাজ লড়াই করেছে। এই যে আড়াই লাখের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা আছে, সেখানে দেখেন শতকরা ৯০-৯৫ জনেরও বেশি হচ্ছেন কৃষক শ্রেণির লোকজন। এগুলো তো মানুষ ভুলে যাচ্ছে।
একটি বই আমি সম্পাদনা করেছিলাম, অনেকদিন আগে। বইটির নাম ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’। এটি ইতালিয়ান দার্শনিক আন্তনিও গ্রামসির ইংরেজি কথা প্যাসিভ রেভ্যুলুশনের অনুবাদ। অর্থাৎ আমাদের রেভ্যুলুশনটা জনগণের হাতে আর নাই। এটা অন্যের হাতে চলে গেছে। আপনারা সবাই জানেন, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি বছরই কত কোটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হচ্ছেন। এটা আমরা জাতীয় উন্নতি হিসেবে দেখতে পারি; কিন্তু বাংলাদেশে খুন-ধর্ষণ-রাহাজানি কি কমেছে? সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সাহেব বলেছেন, ‘এখনো অনেক পরিবারকে ধ্বংস করছে মাদক।’ আমরা মাদকে কি করে এসে পৌঁছলাম? আপনি কি এটাকে অকারণ মনে করেন?
রাহাত মিনহাজ: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশর বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, এমনকি বর্তমানে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে আপনি অনেক কথা বলেছেন। এ বিষয়ে যদি আর কিছু বলতে চান...
সলিমুল্লাহ খান: আমাদের দেশে ডাক্তাররা বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলীরা বুদ্ধিজীবী, হিসাবজীবীরা বুদ্ধিজীবী, সরকারি আমলারা বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্ররাও বুদ্ধিজীবী। তবে শেষ পর্যন্ত নানা বিষয়ে ছাত্রদের ভূমিকা নিতে হয়। রাস্তায় ছাত্রদের নামতে (নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন) হয়; কিন্তু কেন? সিটি করপোরেশনের গাড়ি চালকের লাইসেন্স নেই। সে নটর ডেম কলেজের ছাত্রকে মেরে ফেলে। রাস্তায় এসে ছাত্রদের লাইসেন্স পরীক্ষা করতে হয়। তাতে কি বোঝা যাচ্ছে? তাতে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের সমাজ এখনো আদিম পর্যায়ে আছে। আপনি আলাপচারিতায় প্রশংসামূলক অনেক কথা বলেছেন, এটা আপনার চাকরি। আর আমার চাকরি হচ্ছে, হতাশার কথা বলা।
আসুন আমরা এই চুক্তিতে আসি। আমাকে হতাশার কথাগুলো বলার জন্য গলা টিপে দেবেন না।
রাহাত মিনহাজ: গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও আলোচনার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সলিমুল্লাহ খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
(শেষ)
আরও পড়ুন
প্রথম পর্ব
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের প্রধান সমস্যা দেশের ইতিহাস সম্পর্কে খণ্ডিত ধারণা নিয়ে অগ্রসর হওয়া
দ্বিতীয় পর্ব
দেশে এখন কূটনীতিই প্রবল, রাজনীতি আর নেই
তৃতীয় পর্ব
বাংলাদেশের সাহিত্যে আমরা এখন অন্ধকার যুগে আছি, আরবিতে যাকে বলে আইয়ামে জাহেলিয়াত
চতুর্থ পর্ব
আপস করে বড় সাহিত্য লেখা সম্ভব নয়
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে